কাগজ শিল্প ধংসে মরিয়া আমদানিকারক চক্র


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


কাগজ শিল্প ধংসে মরিয়া আমদানিকারক চক্র

কাগজ উৎপাদনে দেশ অনেক আগেই সয়ংসম্পন্ন হলেও নানা অযুহাতে আমদানি থেমে নেই। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশে অবাধে ঢুকছে আমদানিকৃত কাগজ। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত আমদানি হওয়া কাগজ, বোর্ড, বস্ত্রসহ নানা পণ্য খোলাবাজারে দেদারসে বিক্রি হওয়ায় টিকতে পারছে না দেশি শিল্প। ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা শিল্প খাতটিতে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুনছেন উদ্যোক্তারা। ১০৬টির মধ্যে মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৭৯টি বেশি কাগজকল। 

এমন প্রেক্ষাপটে কাগজ আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধির দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে আশঙ্কা করা হয়েছে, বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ ও কাগজ আমদানিতে শুল্ক না বাড়ানো হলে দেশীয় কাগজ শিল্প অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে ২৩ জুন অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়েছে, কতিপয় ভূঁইফোড় ও স্বার্থান্বেষী আমদানিকারক এবং মূদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় মিল থেকে কাগজ সংগ্রহ না করে রেয়াতি শুল্কে কাগজ আমদানীর পায়তারা করছে। এই অপতৎপরতার একমাত্র উদ্দেশ্য অমিত সম্ভাবনাময় দেশীয় কাগজ শিল্প ধ্বংস করা। যেখানে দেশীয় মিলকে উৎপাদিত কাগজ বাজারজাতকরণের জন্য ভ্যাট ও অগ্রীম আয়কর প্রদান করতে হয় সেখানে রেয়াতি শুল্কে কাগজ আমদানীর অনুমতি দেওয়া হলে স্থানীয় ও আমদানীকৃত কাগজের মধ্যে তীব্র বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। তাই রেয়াতি শুল্কে কাগজ আমদানীর প্রস্তাব বিবেচনা না করার জন্য আহবান জানিয়েছে পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১০৬টি কাগজ শিল্পে ৩১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬ হাজার ১১২ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। এ অবস্থায় দেশীয় কাগজ শিল্পকে প্রায় বিনা শুল্কে আমদানিকৃত বিদেশি কাগজের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেয়াটা এ শিল্পের জন্য হুমকি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) মহাসচিব ও মাগুরা পেপার মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহীউদ্দিন বলেন, ‍“দুই একটি স্পেশালিটি পেপার প্রেডাক্ট ছাড়া বাংলাদেশে এই মুহুর্তে কাগজ আমদানির প্রয়োজন নেই। বরং বাংলাদেশ থেকে ৪০টির বেশি দেশে কাগজ রপ্তানিও হচ্ছে। যেখানে রপ্তানি করার যোগ্যতা রাখে বাংলাদেশ সেখানে আমদানি করা যথার্থ নয়। তাই দেশিয় শিল্পের বিকাশে আমদানি শুল্ক দুই-তিনগুণ বাড়ানো উচিত।”

ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে এই শিল্পদ্যোক্তা বলেন, প্রতিবেশি দেশে আমদানি কাগজ থাকলেও খুব উচ্চ শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে হয়। তাই আমাদের দেশেও একই নীতি গ্রহন না করলে দেশিয় কাগজ শিল্প ধংস হয়ে যাবে। 

কাগজ শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, ‘আশির দশকে দেশীয় কাগজ শিল্পের বিকাশ শুরু হলেও নব্বইয়ের দশকে বড় বড় শিল্পগ্র“প এই খাতে বিনিয়োগে আসায় কাগজ শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। আমদানিনির্ভর এই খাতটি রপ্তানিতেও পা বাড়ায়। দেশের ১০৬টি কাগজ মিল স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে ৪০টির বেশি দেশে কাগজ রপ্তানি করছে। মিলগুলোয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে ১৫ লাখ মানুষ, পরোক্ষভাবে এই সম্পৃক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এ শিল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্বও পাচ্ছে এ শিল্প থেকে। চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন দেশের কাগজ মিলগুলো অফসেট, নিউজপ্রিন্ট, লেখা ও ছাপার কাগজ, প্যাকেজিং পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়া পেপার, লাইনার, স্টিকার পেপার, সিকিউরিটি পেপার ও বিভিন্ন গ্রেডের টিস্যু পেপার উৎপাদন করে। তবে উৎপাদিত পণ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই লেখা এবং ছাপার কাগজ, যা শিক্ষার অন্যতম উপকরণ। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কাগজ মিলগুলোর। দেশে বিভিন্ন ধরনের কাগজের চাহিদা প্রায় নয় লাখ টন। তবে দেশীয় কাগজ মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। কাগজ মিলগুলোর মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি মিল বড়। বাকিগুলো ছোট কারখানা। দেশের পেপার মার্কেটের আকার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাক্রা। যার মধ্যে মোট বাজারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লেখা ও ছাপার কাগজ পণ্য। আর অবশিষ্ট ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ অন্যান্য পণ্য।’ 

বিপিএমএর তথ্য মতে, দেশের পেপার শিল্পখাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যার সাথে ৩০০ উপ-শিল্প তথা সহায়ক শিল্প যেমন মুদ্রণ, প্রকাশনা, কালি প্রস্তুত, ডেকোরেশন, প্যাকেজিং ও বাঁধাই শিল্প জড়িত। 

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার: দেশীয় কাগজ শিল্প উৎপাদনে সয়ংসম্পন্ন হওয়া সত্বেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশে অবাধে ঢুকছে আমদানিকৃত কাগজ। প্রায় বিনা শুল্কে আনা এসব কাগজ খোলাবাজারে দেদার বিক্রি হওয়ায় দেশীয় কাগজ শিল্প মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আমদানিকৃত কোটেড পেপার, গ্রাফিক পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, মিডিয়া পেপার, সেলফ অ্যাডহেসিভ পেপারে রাজধানীর বাজার সয়লাব। যাদের সহায়তায় এসব কাগজ বিক্রি হচ্ছে তাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে অব্যাহত রাখা হচ্ছে এ বাণিজ্য। কাগজ আমদানির বেশিরভাগ বন্ড আবার ভুয়া। অসাধু কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় কাগজ আমদানিকারকরা এত শক্তিশালী যে, কয়েকদিন আগে পুরান ঢাকায় কাগজের মার্কেটে অভিযান চালাতে গেলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের তাদের হাতে নাজেহাল হতে হয়।

তাই দেশীয় কাগজ শিল্পকে বাঁচাতে হলে আমদানিকৃত কাগজের ওপর শুল্ক বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিপিএমএর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “বিগত দিনে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য দেশি কাগজ মিলগুলো গুণগত মানসম্পন্ন কাগজ সরবরাহ করে এসেছে। কাগজশিল্প বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাগজশিল্প আমদানি বিকল্প, রপ্তানিমুখী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাই রেয়াতি সুবিধায় কাগজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হবে আÍঘাতি। বরং ডলার সংকটের এই সময়ে যেখানে আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে সেখানে আমদানির ওপর আরো শুল্ক আরোপ প্রয়োজন আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”

তিনি বলেন, “এরই মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী অন্যান্য শিল্পে বিনা শুল্কে বন্ড সুবিধার নামে কাঁচামাল হিসেবে কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের দেওয়া বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কারখানায় ব্যবহারের কথা বলে কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে সরকার প্রতিবছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে দেশি কাগজশিল্প অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে লোকসানে ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাবে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবেক চেয়াম্যান আবদুল মজিদ বলেন, “তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিনা শুল্কে আমদানীকৃত কাগজজাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এর সঙ্গে বিনা শুল্কে পাঠ্যপুস্তকের জন্য ব্যবহƒত কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে আর্থিক ক্ষতি আরো বাড়বে। দেশি কাগজশিল্প লোকসানে শেষ হয়ে যাবে।”   

বাজেট প্রস্তাব: দেশীয় কাগজ মিলসমূহে বর্তমানে আমদানি বিকল্প পণ্য সেলস কপি পেপার উৎপাদন হচ্ছে যা দীর্ঘদিন যাবত আমদানি করে দেশের চাহিদা মিটানো হতো। দেশের বাজারে থার্মাল পেপারের প্রচুর চাহিদা থাকায় এবং বর্তমান সরকারের উদার শিল্পনীতির সুযোগে এ যাবৎ আমদানিকৃত এই পণ্যের বিকল্প হিসাবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করছে। আমদানিকৃত সেলস কপি পেপারের চাইতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের গুনগত মানও ভালো। এছাড়া এই উন্নতমানের কাগজ তৈরী হওয়ায় আমদানি নির্ভরতা কমছে এবং বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বাজেটে কাগজশিল্পে ব্যবহƒত বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের রাসায়নিকের আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার হ্রাসের প্রস্তাব এবং আমদানীকৃত ফিনিশড পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপেরও দাবি করেছেন বিপিএমএর নেতারা। এছাড়া পরিবেশ সহায়ক শিল্পকে উৎসাহ দানে মাইক্রো ক্যাপসুলের আমদানি পর্যায়ে কাস্টম ডিউটি (সিডি) ২৫% সম্পূর্ন প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। 

এসএ/