‘তরুণ প্রজন্মই হতে পারে আগামী নির্বাচনের গেইম চেঞ্জার’

খ্যাতনামা একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছিলেন ‘যে জাতির তরুণরা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে এবং তার জন্য সংগ্রাম করে, সেই জাতির ভাগ্য রুদ্ধ করা যায় না।’ প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির সেই বিখ্যাত উক্তি ‘The energy, the faith, the devotion which youth bring to their cause will light our country and all who serve it.’
বিজ্ঞাপন
আজও পৃথিবীর প্রতিটি প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়, তরুণরা হচ্ছে পরিবর্তনের প্রকৃত চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, এদেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে তরুণ প্রজন্মই ছিল প্রধান ভূমিকায়।
সুতরাং বলা যায়, আগামী নির্বাচনে দেশের তরুণ প্রজন্মই হতে পারে আসল গেম চেঞ্জার, যারা কেবল ভোটের মাধ্যমে নয়, বরং নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সুশাসনের ভিত্তি গড়ে দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বারবার আন্দোলনের সূতিকাগার বলা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তরুণ ছাত্রদের আত্মত্যাগই জাতিকে মাতৃভাষার অধিকার এনে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজপথ থেকে শুরু হওয়া ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সরাসরি পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আর স্বাধীনতার সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ১৯৮০-র দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাই ছিলেন অগ্রভাগে। এমনকি সাম্প্রতিককালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা কোটা সংস্কার আন্দোলন সবই প্রমাণ করেছে যে, দেশের তরুণরা অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করে না। এ কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বোঝার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোর আন্দোলনের ইতিহাস জানাটা অপরিহার্য।
বিজ্ঞাপন
২০২৪ সালের ঘটনাপ্রবাহে আমরা স্পষ্টভাবে দেখেছি, তরুণ প্রজন্ম কিভাবে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। জেনারেশন জেডের রয়েছে তুমুল শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। তারা খুব সহজেই সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে দ্রুত সংগঠিত হয়ে উঠতে পারে। তাদের সাহসী কণ্ঠস্বর, লাইভ ভিডিও, স্ট্যাটাস, টুইট ও অনলাইন প্রচারণা লাখো মানুষকে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে। একসময় অপ্রতিরোধ্য মনে হওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা তরুণদের তীব্র আন্দোলনে ভেঙে পড়েছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থা যে তরুণদের জাগরণের ঝড়ে শেষপর্যন্ত পতনের দিকে গড়ায়, সেটি ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ নেপালের দিকে তাকালেই দেখা যায়, সেখানে রাজতন্ত্রের পতনেও তরুণ ছাত্র-যুবকেরাই অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। বিশ্বব্যাপীও একই চিত্র অনুমেয়। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত, হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার ছাত্র আন্দোলন সবখানেই তরুণ প্রজন্ম নতুন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছে এবং সেটির জন্য রাস্তায় নেমেছে। ফলে তরুণদের আন্দোলন আজ আর কেবল স্থানীয় বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক পরিবর্তনের অন্যতম শক্তি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ডাকসু কিংবা জাকসুর মত ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে তরুণরা কেবল আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় না, বরং স্বচ্ছতা, নেতৃত্ব, যুক্তি, তথ্য ও যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দেয়। তাদের রায়ে স্পষ্ট হয় যে তারা অন্ধ আনুগত্যে বিশ্বাস করে না। তারা চায় এমন নেতৃত্ব, যারা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করবে, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে এবং ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর নীতি প্রণয়ন করবে। এই ধারা যে জাতীয় নির্বাচনেও প্রবলভাবে প্রতিফলিত হবে তা স্পষ্ট।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অতীতে ছিল একেবারেই ভিন্ন রকম। স্বাধীনতার পরপরই একদলীয় আধিপত্য, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল কিংবা ক্ষমতাসীনদের একতরফা জয় এসব ছিল নির্বাচনকালীন দৃশ্য। ভোট মানে ছিল আনুষ্ঠানিকতা, যেখানে জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হতো না। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সেই বাস্তবতায় বিশ্বাস করে না। তারা তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বেড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের হাতে ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তারা প্রতিটি ঘটনাকে যাচাই-বাছাই করে দেখে, তথ্য খোঁজে, এবং নেতাদের প্রতিশ্রুতিকে মিলিয়ে দেখে বাস্তবতার সাথে। ফলে আগামী নির্বাচনে তরুণদের রায় হবে অনেক বেশি সচেতন, তথ্যভিত্তিক ও প্রভাবশালী।
উল্লেখ্য যে, নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় তিন কোটি তরুণ ভোটার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, যা মোট ভোটারের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। সুতরাং সংখ্যাটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি ভবিষ্যতের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি।
পূর্ব প্রজন্ম ও বর্তমান প্রজন্মের চাহিদার মধ্যেও রয়েছে বিশাল ফারাক। পূর্ব প্রজন্ম যেখানে খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূর্ণ হওয়াকেই বড় অর্জন হিসেবে দেখত, সেখানে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম চায় মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থান, ডিজিটাল অবকাঠামো, সুলভ স্বাস্থ্যসেবা, এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সুযোগ। তারা চায় পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব এবং সুশাসন। ফলে তাদের চোখে আগামী দিনের নেতৃত্ব হতে হবে এমন, যারা শুধু পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি করবে না, বরং নতুন প্রজন্মের বাস্তবতা, স্বপ্ন ও চাহিদাকে প্রতিফলিত করবে।
বিজ্ঞাপন
তরুণদের কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে একটি অংশগ্রহণমূলক, কল্যাণকর, সাম্য ও মানবিক সমাজ। তারা চায় বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ, যেখানে ধনী-গরিব সবাই সমান সুযোগ পাবে। তারা চায় নারীর প্রকৃত অধিকার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা। তাদের জন্য নেতা নির্বাচনের মানদণ্ড কেবল জনপ্রিয়তা বা দলীয় পরিচয় নয়; বরং যোগ্যতা, সততা, নৈতিকতা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনাই মুখ্য। তাই ভবিষ্যতের নির্বাচনে যেসব নেতৃত্ব এই চাহিদার সাথে তাল মেলাতে পারবে, কেবল তারাই তরুণদের সমর্থন পাবে।
তরুণদের অংশগ্রহণ কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও অপরিহার্য। বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি। এই অগ্রগতির বড় অংশ এসেছে তরুণ উদ্যোক্তা, তরুণ শ্রমশক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর স্টার্টআপদের হাত ধরে। ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা ব্লকচেইন এসব নতুন খাতে তরুণদের অবদান বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচিত করছে। ফলে তাদের ভোট কেবল রাজনৈতিক মানচিত্র নয়, অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করবে।
এখানেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ তরুণরা যত বেশি সচেতন হচ্ছে, তত বেশি তারা সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ প্রশাসন এবং জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক নেতৃত্ব দাবি করছে। তারা চায় এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, যেখানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি থাকবে না, এবং যেখানে নেতৃত্ব জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তরুণদের এই চাহিদাকে উপেক্ষা করলে কোনো রাজনৈতিক দলই দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারবে না।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বমানের একটি জাতি গঠনের স্বপ্ন মূলত তরুণদের হাতেই নিহিত। শিক্ষা, দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং নৈতিকতায় সমৃদ্ধ তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাশীল করে তুলতে পারে। তারা প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করেছে, বৈশ্বিক প্রবণতা বোঝে, এবং পরিবর্তনের জন্য সাহসী। তাদের স্বপ্ন কেবল নিজেদের জন্য নয়, বরং একটি ন্যায্য, মানবিক ও অগ্রসর বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য।
এছাড়া, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। কারণ তারা জানে, ভবিষ্যৎ পৃথিবী তাদের হাতেই। বাংলাদেশের তরুণরাও এর বাইরে নয়। তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করছে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা শুধু দেশের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তরুণরা নিজেরা স্বপ্ন দেখছে, আবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরন্তর লড়াই করছে। তাদের দৃঢ়তা, আদর্শ ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিই একদিন বাংলাদেশকে একটি বিশ্বমানের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
অতএব একথা খুবই স্পষ্ট যে, আগামী নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মই হবে আসল গেম চেঞ্জার। তারা যদি সচেতনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, সাহসের সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এবং যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন মোড়ে প্রবেশ করবে। সেটি হবে অংশগ্রহণমূলক, কল্যাণকর, সাম্যনির্ভর ও মানবিক সমাজ নির্মাণের সূচনা। এই তরুণরাই বাংলাদেশকে বিশ্বমানের একটি আধুনিক জাতি হিসেবে গড়ে তুলবে। আর সেই যাত্রার প্রথম ধাপ শুরু হবে ব্যালট বাক্সে তাদের দৃঢ় ও সচেতন রায় দিয়েই।
বিজ্ঞাপন
লেখক: সুলতান মাহমুদ সরকার
এমফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।