একটি শিশুর শূন্যতা আর একটি দেশের দায়

হাদির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি ঘর নিঃশব্দ হয়ে গেছে। কান্নার শব্দ আছে, মানুষের ভিড় আছে, শোকের আনুষ্ঠানিকতা আছে তবু সেই ঘরটিতে বাবা নেই।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তাই পরিবারের, আর সেই ক্ষতের গভীরে পড়ে আছে এক অবুঝ শিশু যে এখনও বুঝে উঠতে শেখেনি, ‘বাবা’ মানে কী। আপনার ঘরে কি এক বছর বয়সী কোনো সন্তান আছে? সদ্য বাবা-চেনা চোখে নিজেকে দেখেছেন কখনো? সেই চোখে যখন প্রথমবার নিরাপত্তা জন্ম নেয়, তখনই যদি পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় সে অন্ধকারের নামই তো এতিমত্ব।
চোখ বন্ধ করুন। ভাবুন, আপনি নেই। শিশুটি হাঁটতে শিখবে— আপনি নেই। প্রথম শব্দ উচ্চারণ করবে— আপনি নেই। ভয় পেলে, কাঁদলে, রাতের অজানা দুঃস্বপ্নে বুক খুঁজবে আপনি নেই। যে খুনসুটি, যে আদর-সোহাগ, যে নিঃশব্দ মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া এসব ছাড়া দশ মাসের একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠা মানে কেবল বয়স বাড়া, জীবন নয়। এই ক্ষতির কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। না রাষ্ট্র পারে, না সময় পারে, না কোনো সান্ত্বনা।
আরও পড়ুন: বিজয় দিবস: ইতিহাস, দায়িত্ব ও আত্মসম্মান
বিজ্ঞাপন
ক’দিন পরপর হাদির নাম উচ্চারিত হবে। তারিখে তারিখে স্মরণ হবে। মঞ্চে মঞ্চে হাদির বরাতে দেশপ্রেমের কথা বলা হবে। কিন্তু সেই শিশুটি কোনোদিন বাবার পাশে বসতে পারবে না। কেউ আদর করে বলবে না—‘আমি আছি।’ কেউ বাবার মতো বুকের ভেতর পৃথিবীটাকে নিরাপদ করে দেবে না।
হাদির অপরাধ ছিল দেশপ্রেম, হাদির সন্তানের অপরাধ কী?
রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়েছে— এই বাক্যে কোনো সান্ত্বনা নেই। সান্ত্বনা নেই যতক্ষণ হাদির খুনি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়। বাবা ছাড়া মানুষ বাঁচে— এ কথা সত্য। কিন্তু বাবার খুনি বেঁচে আছে— এই বোধ নিয়ে বাঁচা এক ধরনের প্রতিদিনের মৃত্যু। হাদির ছেলের কথা ভাবছি। সদ্য বিধবা হয়ে যাওয়া মেয়েটির কথা ভাবছি। আর ভাবছি সেই মায়ের কথা— যিনি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন প্রার্থনার ভেতর দিয়ে, আর গ্রহণ করলেন লাশ নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে ব্যথাতুর হই হাদির ছেলের মুখচ্ছবি দেখে। সেই মুখে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো অভিযোগ নেই— আছে শুধু না-বোঝার নিষ্পাপ বিস্ময়। যে শিশুটি বুঝতেই শিখল না বাবা কী, সেই শিশুটিই আজীবনের জন্য বাবা-হারা। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম বঞ্চনা হলো— বাবা থাকা সত্ত্বেও বাবাকে না পাওয়া। বাবা সবার হৃদয়ে বাঁচবে অথচ হাদিপুত্র আর একবারও বাবার স্পর্শ পাবে না।
হাদিবাদ কোনো ব্যক্তির নাম নয়— এ এক চিরন্তন অবস্থান। আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষের প্রতিরোধে হাদির আত্মত্যাগ হয়ে থাকবে আলোর স্তম্ভ। যুগে যুগে হাদির ‘চির উন্নত মম শির’ মাথা উঁচু করতে সাহস জোগাবে। তবু প্রশ্ন থেকে যায়— হাদির রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ স্বপ্নের ভার কি আমরা নিতে পারব? এমন একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব?- যেখানে কোনো শিশুকে বাবার অভাব বুঝে বড় হতে হবে না।
বিজ্ঞাপন
হাদির বিদেহী আত্মার কাছে আমাদের দায় শেষ হয় না। ন্যায় ও ন্যায্যতার সঙ্গে বাঁচার প্রতিটি অঙ্গীকারেই তাকে স্মরণ করতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে— আমরা কি সত্যিই তাঁর দেখানো পথে হাঁটছি, না শুধু তার নাম উচ্চারণ করে দায় সেরে নিচ্ছি?
ঘরে সব আছে— শূন্য একটিমাত্র জায়গা ছাড়া। অবুঝ শিশুটির বাবা নেই। দেশে অনেক কিছু আছে— একটি নামের শূন্যতা ছাড়া। হাদি নেই। এই শূন্যতা পূরণযোগ্য নয়। সন্তানের কাছে পিতার জায়গা কেউ নিতে পারে না। দেশপ্রেমিকের শূন্যস্থানও কেউ পূরণ করতে পারে না। আমরা আরেকজন হাদি পাব না— যেমন দ্বিতীয়বার নজরুল পাইনি। যে ক্ষণজন্মাকে ভাগ্যগুণে পেয়েছিল এই মাটি, তাকেই নির্মম বুলেটের কাছে হারাতে হলো।
বিজ্ঞাপন
তবু হাদি হারায়নি, হাদি হারবেও না।
কারণ দেশপ্রেমের দীর্ঘ যাত্রায় হাদি এখন কেবল একজন মানুষ নয়— একটি পথ। সেই পথে আরও লাখো হাদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দাঁড়াতেই হবে। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই কোনো দিনের নয়, কোনো প্রজন্মের নয়। আবরার–হাদি এই যাত্রার শুরু নয়, শেষও নয়। কারণ সত্য কখনো নিজে নিজে বাঁচে না— সত্যকে প্রতিদিন লড়াই করেই বাঁচিয়ে রাখতে হয়। স্বার্থের দুনিয়ায় অধিকার কেউ কাউকে দেয় না- অধিকার আদায় করতে হয়।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।








