Logo

রক্তের বিনিময়ে লেখা স্বাধীনতার সূর্যোদয়

profile picture
জনবাণী ডেস্ক
১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১৮:০৬
4Shares
রক্তের বিনিময়ে লেখা স্বাধীনতার সূর্যোদয়
ছবি: সংগৃহীত

মো: আবদুল কাদের রাজু: ১৬ ডিসেম্বর বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে এমন এক সকাল, যে সকাল আমাদের অস্তিত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে।

বিজ্ঞাপন

এদিনের সূর্য উদিত হয় লাল–সবুজের গৌরবগাথা নিয়ে, উদিত হয় এক জাতির পুনর্জন্মের অগ্নিগর্ভ স্মৃতি বহন করে। বিজয় দিবস শুধু একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের দিন নয়—এটি বাঙালির আত্মপরিচয়, ত্যাগ, সাহস, বেদনা আর অশেষ ভালোবাসায় লেখা অমর ইতিহাসের দিগন্ত। আমরা বইয়ের পাতায় হয়তো পড়ি নয় মাসের যুদ্ধ, ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা–বোনের বেদনার কথা, কিন্তু এই বিজয়ের ভাঁজে লুকিয়ে আছে আরও অসংখ্য গভীর, কম–জানা অধ্যায়—যা জানলে একদিকে শিউরে ওঠে শরীর, অন্যদিকে গর্বে ভরে ওঠে মন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার উত্তাল সূচনা হয়েছিল ২৫ মার্চের গণহত্যার অনেক আগে থেকেই। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই পূর্ববাংলার সীমান্তজুড়ে ইপিআর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছোট সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন—যেন আগেই তারা বুঝতে পেরেছিলেন, অন্ধকারের এক ঝড় এগিয়ে আসছে। মেজর জলিল, মেজর শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন হালিমসহ দেশপ্রেমিক কর্মকর্তারা গোপনে অস্ত্র জমাচ্ছিলেন, সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন, প্রস্তুত করছিলেন এক অঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের জন্য। আর ২৫ মার্চের রাত—মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস রাতগুলোর একটি—যখন পাকিস্তানি বাহিনী ডাকা দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর। সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ হল, পুরান ঢাকা—সবচেয়ে আলোকিত জায়গাগুলো মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুর শহরে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলার পথ দেখাতে তারা ব্যবহার করেছিল নিজেদের রাজনৈতিক সমর্থকদের—একটি নির্মম সত্য, যা আজও অনেকের অজানা। ঢাকা মেডিকেল থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তায় হাজারো মানুষের লাশ পড়ে ছিল—যেন পুরো শহর এক রাতে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের শ্বাস।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল অদম্য বিশ্বাস, আর সেই বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিছু গোপন কৌশল। ভারতের আগরতলা, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে স্থাপন করা হয়েছিল বাংলাদেশের গোপন অস্ত্র কারখানা—যা নিয়ে খুব কম বইয়ে লেখা আছে। মাত্র সাত মাসে এখানে তৈরি হয়েছিল আশি হাজারের বেশি হ্যান্ড গ্রেনেড, বিশ হাজার ল্যান্ডমাইন এবং শত শত রকেট–বোমা। এসব অস্ত্র দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের বহু ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। একই সময় জন্ম নেয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’—যা ছিল এই যুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র। তিনবার পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালিয়ে একে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রতি বারই এটি নতুন জায়গায় উঠে দাঁড়িয়েছিল—যেমন দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ নামের এক জাতি।

যুদ্ধের প্রথম সাত মাস ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি—আন্তর্জাতিক চাপ, বৈশ্বিক রাজনৈতিক জটিলতা, এবং আমেরিকা–চীন–পাকিস্তান জোটের কূটনৈতিক বেড়াজাল ভারতকে আটকে রেখেছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানকে সহায়তা করতে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগিয়েছিল—একটি ঘটনা, যা আজও অনেকের জানা নেই। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে বিমান হামলা চালানোর পর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। তারপরই শুরু হয় ইতিহাসের দ্রুততম সামরিক অভিযানগুলোর একটি—মাত্র ১৩ দিনে পতন ঘটে পাকিস্তানি বাহিনীর।

বিজ্ঞাপন

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট—ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক আত্মসমর্পণ ঘটে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজি ৯৩,০০০ সৈন্যসহ স্বাক্ষর করেন জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণপত্রে। সেই মুহূর্তে ঢাকার আকাশে উড়ছিল হাজারো লাল–সবুজ পতাকা—বাংলার মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু সে কান্না ছিল বিজয়ের কান্না, মুক্তির কান্না।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশও ছিল একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। প্রায় এক–তৃতীয়াংশ গ্রামাঞ্চলে ল্যান্ডমাইনের ঝুঁকি রয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিল চার শতাধিক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা—যাদের ফিরিয়ে আনতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চলেছিল তীব্র কূটনৈতিক আলোচনা। যারা মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করেছিলেন, তাদের অনেকেই যুদ্ধের পর দেশে ফিরেছিলেন নিঃস্ব, পরিবারহারা, জীবনের কঠিন বাস্তবতা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি স্বীকৃতি পেতেও লেগেছিল ছয় বছর—১৯৭৭ সালে প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়। আরও একটি কম–জানা সত্য হলো—১৯৭১ সালের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের অনেক শক্তিধর দেশ দীর্ঘ সময় নীরব থেকেছিল। বিদেশি সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ও সাইমন ড্রিং নিজেদের জীবন বাজি রেখে সত্য তুলে ধরেছিলেন—যার ফলে পৃথিবী পাকিস্তানের বর্বরতা স্পষ্টভাবে জানতে পেরেছিল।

বিজ্ঞাপন

বিজয় দিবস আমাদের শেখায়—স্বাধীনতা কোনোদিন বিনামূল্যে আসে না; এটি আসে ত্যাগের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে, অশ্রুর বিনিময়ে। বাঙালি জাতি ছোট হলেও পরাজয় মানে না—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে অসম্ভবকেও জয় করা যায়। তাই ১৬ ডিসেম্বর শুধু একটি তারিখ নয়—এটি আমাদের হৃদয়ের গভীরে লেখা রক্তের কবিতা, আমাদের বেঁচে থাকার শুদ্ধতম প্রমাণ, আমাদের আত্মমর্যাদার সূর্যোদয়। আজ যখন আমরা লাল–সবুজ পতাকার দিকে তাকাই, তখন মনে রাখা উচিত—এই পতাকার প্রতিটি রঙে লুকিয়ে আছে ত্রিশ লাখ শহীদের নিঃশব্দ চিৎকার, দুই লাখ মা–বোনের অশ্রু, আর একটি জাতির মুক্তির অগ্নিস্মৃতি। বিজয় দিবস উদযাপনের অর্থ শুধু পতাকা ওড়ানো নয়—এটি ইতিহাসকে সত্যিকারের সম্মান করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাধীনতার মূল্য শেখানো, এবং মনে রাখা—১৬ ডিসেম্বরের সূর্যোদয় ছিল আমাদের জাতির সবচেয়ে আলোকিত ভোর।

জেবি/এসএ
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD