অনলাইন নজরদারিতে নতুন যুগ, শর্তে আড়িপাতার অনুমতি

বাংলাদেশের ডিজিটাল যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। এবার শুধু টেলিফোন বা মোবাইল অপারেটর নয়— ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, নেটফ্লিক্স, টিকটকসহ সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মও সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও অনুমোদনের আওতায় আসবে। এর মাধ্যমে ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ, ভিডিও স্ট্রিমিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ওভার দ্য টপ (ওটিটি) সেবা এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) সব কিছু থাকবে সরকারের তদারকিতে।
বিজ্ঞাপন
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে, যা কার্যকর হলে বাতিল হয়ে যাবে ঔপনিবেশিক যুগের টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫ এবং ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইন ১৯৩৩।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সেবা দিতে হলে যে কোনো সামাজিক মাধ্যম বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে সরকারের অনুমোদন ও নিবন্ধন নিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ব্যবহারকারীর তথ্য সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে নিরাপত্তা সংস্থাকে তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকবে। অর্থাৎ, বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলোকেও এখন বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
প্রযুক্তি বিশ্লেষক সুমন আহমেদ সাবির মনে করেন, এই আইন রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা বাড়াতে পারে, তবে নাগরিকের গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।
তার মতে, নজরদারি প্রয়োজন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রূপ নিলে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার স্পষ্ট নিশ্চয়তা না থাকলে এটি পরিণত হতে পারে নজরদারি রাষ্ট্রের আইনে।
খসড়ার ধারা ৯৭ ও ৯৭(খ) অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অপরাধ তদন্ত বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে আদালতের অনুমোদন নিয়ে আড়িপাতা বা যোগাযোগে নজরদারির সুযোগ থাকবে। এজন্য গঠন করা হবে কেন্দ্রীয় আইনানুগ ইন্টারসেপশন প্ল্যাটফর্ম (সিএলআইপি), যা পরিচালিত হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
বিজ্ঞাপন
এই নতুন কাঠামো চালু হলে বর্তমান ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কার্যত বিলুপ্ত হবে এবং তার কার্যক্রম সিএলআইপিতে একীভূত হবে।
নতুন খসড়ায় বর্তমান বিটিআরসি-র জায়গায় গঠিত হবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কমিশন—একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, যার সদস্য থাকবেন পাঁচজন। তবে এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সরকারের নীতিনির্ধারণী নির্দেশনার ওপর নির্ভরশীল থাকবে, ফলে স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এক সাবেক বিটিআরসি কমিশনার মন্তব্য করেছেন, নাম বদলালেই স্বাধীনতা বাড়ে না, যদি নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকে।
বিজ্ঞাপন
প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা বলছেন, নিবন্ধন ও অনুমোদনের প্রক্রিয়া অতিরিক্ত জটিল হলে নতুন স্টার্টআপ বা উদ্ভাবনী উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
উদ্যোক্তা মুস্তাকীম বিল্লাহ বলেন, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া যত জটিল হবে, উদ্ভাবনের গতি তত ধীর হবে। তরুণ উদ্যোক্তারা নতুন ধারণা বাস্তবায়নে নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ ২০২৫ সময়োপযোগী উদ্যোগ হলেও এর প্রয়োগ কাঠামো ও ভারসাম্যই নির্ধারণ করবে এটি ডিজিটাল নিরাপত্তার আইন, নাকি নজরদারি রাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
দেশের ডিজিটাল নীতি ও মানবাধিকার রক্ষার ভারসাম্য বজায় রেখেই আইনটি বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন প্রযুক্তি ও আইন বিশেষজ্ঞরা।








