Logo

স্বৈরাচারের দোসর জাবেদ ফের পদ দখলের দৌড়ে

profile picture
বশির হোসেন খান
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১৫:৪৫
13Shares
স্বৈরাচারের দোসর জাবেদ ফের পদ দখলের দৌড়ে
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

বিদ্যুৎ খাত বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। এই খাতের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নির্ভর করে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছ প্রকল্প পরিচালনার ওপর।

অথচ সম্প্রতি এমন এক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, যিনি সাবেক মন্ত্রীর তদবীরের জোরে পদ লাভ করে এখন স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছেন। ঘটনাটি ঘিরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (বিউবো) চলছে চাপা অসন্তোষ, ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ, এবং প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়েও।

অভিযোগ আছে, পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিউবোর তিনি ছিলেন অন্যতম সুবিধাভোগী কর্তকর্মা। আওয়ামী লীগের অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে আয়ত্বে থাকা সকল কাজেই দুর্নীতির ছোঁয়া রেখেছেন। কিন্তু দলীয় আশির্বাদে সব সময় থেকেছেন শাস্তির উর্ধ্বে। সূত্র বলছে, জাবেদ নিজেকে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশির্বাদপুষ্ট হিসেবে জাহির করে ব্যাপক সুবিধা গ্রহণ করেছেন।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নাম বহুবার উচ্চারিত হয়েছে আলোচিত এই ঘটনায়। অভিযোগ রয়েছে, তার ছত্রছায়ায় বিউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ জাবেদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় “প্রিপেমেন্ট মিটারিং ফর ডিস্ট্রিবিউশন (কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জোন)” প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

এই পদটি পাওয়ার জন্য জাবেদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলে তদবীর করে আসছিলেন। শেষে সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে তিনি কাঙ্ক্ষিত পদটি অর্জন করেন।

বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, এই প্রকল্পটি দেওয়া হয় সাবেক প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাইয়ের দেখভালের আওতায় থাকা একটি দীর্ঘসূত্রি সাব-প্রকল্পের সুষ্ঠু সমাপ্তি নিশ্চিত করতে। এ যেন পুরোটাই একটি পারিবারিক সুবিধাবাদী সেটআপ যেখানে জবাবদিহিতা নয়, উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের লোক দিয়ে কাজ আদায়।

জাবেদ হোসেনের বিউবোতে পরিচিতি নম্বর: ১-০১৩৪৩। তিনি একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত হলেও, প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পেয়ে এখন কার্যত একজন অনিয়ন্ত্রিত ‘শাসক’ এ পরিণত হয়েছেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তার স্ত্রীও একই দপ্তরে কর্মরত। ঘর-সংসার থেকেই তৈরি হয়েছে একটি প্রভাবশালী ঘরোয়া নেটওয়ার্ক, যা অফিসিয়াল কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে। অভিযোগ রয়েছে, এই স্ত্রী বর্তমানে বিউবোতে অঘোষিতভাবে ‘ঘুষ বিষয়ক পরামর্শদাতা’ হিসেবে পরিচিত ,যা সরকারি চাকরির নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

বিজ্ঞাপন

জাবেদ হোসেন প্রকল্পে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু করেন নিয়মিত ঘুষ আদায়। গ্রাহক ও ঠিকাদারদের কাজ আটকে রেখে তিনি ঘুষ না পেলে অগ্রগতি থামিয়ে দেন। বিষয়টি শুধু টাকায় সীমাবদ্ধ নয় বলা হয়, ইউএস ডলারে পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। এই বিদেশি মুদ্রা ঠিক কোথায় যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে ধারণা করছেন, এটি হয়তো ব্যক্তিগত লোভ নয় বরং সাবেক প্রতিমন্ত্রীর জন্যই একটি অংশ নির্ধারিত হয়ে পাঠানো হচ্ছে। যদিও এই দাবির পক্ষে এখনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে একাধিক ব্যক্তির একই ধরনের অভিযোগ বিষয়টিকে গুরুতর করে তুলেছে।

জাবেদ হোসেন শুধু একটি প্রকল্পেই থেমে থাকেননি। আগে যে প্রকল্প পরিচালকের অধীনে একটি প্রকল্প চলছিল, তাকে সরিয়ে দিয়ে সেই দায়িত্বও নিজের হাতে তুলে নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ওই প্রকল্পেরও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রকৌশলী প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তরিক নন, বরং এটি দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রেখে কৃত্রিম জটিলতা তৈরি করে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায়ের কৌশল প্রয়োগ করছেন।

প্রকল্প পরিচালনার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সঠিক পদ্ধতিতে টেন্ডার আহ্বান বা মূল্যায়নের বদলে, কো-অর্ডিনেটেড লেনদেনের মাধ্যমে নির্ধারিত কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়েছে। বিউবোর একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘন ঘন কাজের সময় বাড়ানো, সামঞ্জস্যহীন ব্যয় ও নিরীক্ষাহীন পেমেন্ট করা হয়েছে যা প্রাথমিকভাবে দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়।

বিজ্ঞাপন

এতসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা বিউবো কর্তৃপক্ষ কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। বরং জাবেদ হোসেন বর্তমানে নিজেকে বিউবো’র জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) পদে পদোন্নতির জন্য জোর লবিং করছেন বলে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের একজন উপসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,প্রকল্প পরিচালক পদটি প্রকৌশলীদের জন্য সম্মানজনক হলেও এটি চূড়ান্তভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয় না। অথচ এই পদে আসতে যদি কেউ মন্ত্রীর কাছে বারবার তদবীর করেন, সেটি দুর্নীতির পরিকল্পনারই ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে গত এক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বিদেশি ঋণ, অনুদান ও দেশীয় বাজেটের মাধ্যমে। এই খাতকে সামনে রেখে সরকার বড় ধরনের রূপান্তরের চিন্তা করলেও, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মন্ত্রণালয়ের অডিট ইউনিট, অথবা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি পদে থেকে কেউ যদি প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থে পদ ব্যবহার করে, তাহলে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয় পুরো দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। এই ঘটনায় আমরা শুধু একজন প্রকৌশলীর স্বেচ্ছাচারিতা দেখছি না, বরং একটি সিস্টেমিক দুর্নীতির ছায়াও দেখতে পাচ্ছি। বিউবো বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর এখন যদি ব্যবস্থা না নেয়, তবে এমন ঘটনা ভবিষ্যতেও বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করে দেবে। সবার আগে দরকার, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। তা না হলে, ক্ষমতা আর দুর্নীতির অশুভ বন্ধন দিনের পর দিন দেশের সম্পদ লুটেই যাবে।

এ ব্যাপারে বিউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ জাবেদ হোসেনের মুঠোফোনে কল দিলে কল রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা চাকরি করে ক্ষমতার দাপট দেখান কিংবা বৈধভাবে পদ দখলে রাখেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা দেওয়া উচিত। না হলে যোগ্য কর্মকর্তারা ঠিক ভাবে পদোন্নতি হবে না।

বিজ্ঞাপন

জেবি/আরএক্স
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD