আগস্ট- শোক থেকে শক্তি
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বৃষ্টি স্নাত ভোরে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে নির্মম ভাবে হত্যা করে সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য। এর জন্য মার্কিন যোগসাজশের দিকে ইঙ্গিত করে এমন অজস্র প্রমাণ রয়েছে। কতটুকু নিষ্ঠুর হলে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা যায়। মার্কিন যোগসাজশে নৃশংস ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামালকে হত্যা করে। জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধু শেখ নাসেরের ভাই, এসবি সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সাথে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবনে হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হককে হত্যা করে। মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর শ্যালক আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা চালিয়ে সেরনিয়াবাত ও তার মেয়ে বেবী, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাই সজিব সেরনিয়াবাতের ছেলে ও আত্মীয় বেন্টু খানকে হত্যা করে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে অবস্থান করার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দুই বোন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
১৯৮১ সালে দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে শেখ হাসিনা স্বদেশের মাটিতে ফিরেন। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর দিশাহীন বিভক্ত আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্বভার নেন। দেশে ফিরে সেদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরো অনেক প্রিয়জন।” “ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।” শেখ হাসিনা বলেন, “ছয়টি বছর আমরা বিদেশর মাটিতে ছিলাম। ১৯৮১ সালে বাবার হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমার অনুপস্থিতিতে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করে। সেই সময় অনেক বাধা। মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতায়। আমাদের কিছুতেই দেশে আসতে দেবে না। আমি অনেক সংগ্রাম করে দেশে ফিরে আসি জনগণের সমর্থন নিয়ে। আর তখন থেকে আমার একটেই লক্ষ্য ছিল, এই বাংলাদেশকে ঠিক যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন, মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে চেয়েছিলেন- সেভাবেই আমি গড়ে তুলব।”
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওযার পর ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে জনসভাস্থলে বোমা পেতে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়। এরপর ২০০৪ সালের একুশে অগাস্টে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। সেদিন দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মদদে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টায় ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসের শিকার হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা , যার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা । এরপর ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে ধানমন্ডির নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে গ্রেফতার করে। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। এরপর ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে। বিজয়ী দলের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি জানুয়ারি ৬, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে তিনি তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম।
এক আগষ্ট মাসের পিতা ও স্বজন হারানোর শোক আর আরেক আগষ্টে হত্যার চেষ্টা ও ছিন্নভিন্ন লাশ, বিস্ফোরণের শব্দ, আহতদের আর্তনাদ, রক্তাক্ত নেতা-কর্মীদের ছুটোছুটি ২৪ জনকে হত্যার শোককে শক্তিতে পরিনত করে ওনার নেত্রীত্বে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ বছর হয় ২০১৮-১৯। মহামারী আক্রান্ত অর্থবছর ২০২০-২১ এর পর দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বি.বি.এস) চূড়ান্ত হিসাবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জিডিপি ৮.১৫%, যা ছিল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৬.৫৫%, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৭.১১%, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৭.২৮%, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৭.৮৬%।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৬˙২৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালে ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার। ৫০ বছরে অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপির ১৯˙৪৪৮ বিলিয়ন ডলার, ১৯৮১ সালে ২০ বিলিয়ন ডলার, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির ৩১˙৬০ বিলিয়ন ডলার, ২০০০ সালে ৫৩˙৩৭ বিলিয়ন ডলার, ২০০২ সালের জিডিপির ৫৪˙৭২৪ বিলিয়ন ডলার, ২০০৬ সালে ৭১˙৮১৯ বিলিয়ন ডলার, ২০০৯ সালে জিডিপির ছিল ১০২˙৫ বিলিয়ন ডলার, ২০১৬ সালে জিডিপির ২০০ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে জিডিপির ২৫০ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮ সালে ২৭৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯ সালে ৩০২ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে জিডিপির আকার বেড়ে হয় ৩১১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। পঁচাত্তর পরবর্তী দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৪ শতাংশ এবং ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ গড়ে ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে দারিদ্র হার ছিল ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের হিসাবে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে দারিদ্যের হার ২২ দশমিক ৫ এবং ২০২১ সালে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারি তথ্যে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষিখাতের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হার পরবর্তী প্রায় এক দশকে গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে (অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ২০১৮-১৯)। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৭-১৯ অর্থবছরে এই হার ছিল ৩.৯২% এবং ৪.২%।
গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হল পোশাক খাত, যা রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশ, আনুমানিক ৪.৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান। করোনার মধ্যেও গত অর্থ বছরে রপ্তানি খাতে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। এতে গতি ফিরেছে দেশের সার্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা প্রায় ৪০ শতাংশ। রেমিট্যান্স খাত দেশের জিডিপিতে প্রায় ৮.৮ শতাংশ সংযোজন করে এবং জাতীয় আয়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দেশের দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ২০২০ সালের মে মাস থেকে দেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ প্রতি মাসেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এবং অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি-জুন ষাণ্মাসিকে যেখানে দেশে ৮৭৯ কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল, একই বছরের জুলাই-ডিসেম্বর ষাণ্মাসিকে সেই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৯৪ কোটি ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল, যা পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় ৯.২ শতাংশ কম ছিল । ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমলেও মে মাসের পরে থেকে তা বেড়েছে। রেমিট্যান্সের ক্রমবর্ধমান প্রবাহের সাথে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪৪.০৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি মর্যাদা উন্নত এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আগষ্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে শেখ হাসিনার সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব মন্দার কারণে দেশের অর্থনীতি কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন।
লেখক: অভিজিৎ বড়ুয়া অভি।
এসএ/