দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ওভারটাইম বন্ধ

ভালো নেই শ্রমিকরা


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১:২০ অপরাহ্ন, ৩০শে অক্টোবর ২০২২


ভালো নেই শ্রমিকরা
ছবি: জনবাণী

গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন কম থাকায় ওভারটাইম বন্ধ, বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত শিল্প কারখানার শ্রমিকরা। গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার মক্কা মদিনা স্পিনিং মিলের শ্রমিক তানজিনা আক্তার। গত কোরবানী ঈদের পর আর মাংস খেতে পারেনি। মাছের দামেও উর্দ্ধগতি, তাও কিনতে পারেননা। বেতন পেয়ে কিছু চ্যাপা শুটকি কিনেন। দু একটি তরকারীতে দিয়ে কোনমতে ঘ্রান তৈরী করে খেয়ে না খেয়ে আছেন। 


তার মতে, সংসারের চাকা ঘোরাতে এই গাজীপুরে এসেছেন। এতোদিন ভালোই চলছিল। স্বামী দুই সন্তান রেখে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। সন্তানরা তার নানীর সাথে ময়মনসিংহে তারাকান্দার থাকেন। মাসে ওভারটাইম মিলে দশ হাজার টাকার মতো পান। গত দুই মাস ধরে ওভারটাইম বন্ধ করে দিয়েছে মালিক পক্ষ। বাসা ভাড়াও বেড়েছে। ঈদের পর বাড়ী থেকে আসার পর আর টাকা পাঠাতে পারেননি। এদিকে মাস গেলেই বাড়ীতে টাকা পাঠানোর চাপ। সব মিলিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে। 


নোমান গ্রুপের নাইস ফেব্রিকস কারখানায় কাজ করেন চট্রগ্রামের লোহাগড়ার আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, বেসিক বেতনে কি সংসার চলে? গ্যাস নেই অজুহাতে গত মাস থেকেই কারখানায় সি শিফটে বন্ধ করা হয়েছে। মাসে বেতনও উঠাতে পারবো না। এর পর শুনেছি এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে শ্রমিক ছাটাই করবে মালিক পক্ষ তারা তো আর বসিয়ে বসিয়ে আমাদের বেতন দিবে না। দেশের এই এ ক্রান্তকালে দুমুঠো খেয়ে যে বাঁচবো সে নিশ্চয়তাও যে পাচ্ছি না ভাই, নিজের কি হবে স্ত্রী ও সন্তানের কি হবে বা কি হবে। 


গাইবান্দার পলাশবাড়ীর কারখানা শ্রমিক হামিদা বেগম, দুই সন্তানের  উজ্জল ভবিষ্যত তৈরীর লক্ষ্যে গাজীপুরে এসে তালহা স্পিনিং মিলে কাজ নিয়েছেন। দুই বছর পরিশ্রম করে স্বামীর দেনা পরিশোধ করেছেন। এখন তার আয়ে তার স্বামী বাড়ীতে কৃষিকাজ ও দুই ছেলে লেখাপড়া করেন। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও হঠাৎ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে কারখানা কর্তৃপক্ষ উৎপাদন কমিয়ে দেয়ায় বেতনও কমে যাওয়ায় গত দুই মাস ধরে কোন টাকা পয়সা আর বাড়ীতে পাঠাতে পারছেন না। স্বামী সন্তানরা মাস গেলেই টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। কোন উপায় না পেয়ে এমাসে কারখানার কাজের পাশাপাশি স্থানীয় দুটি বাসায় ঝিয়ের কাজ নিয়েছে। তার মতে,পরিশ্রম করছি, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটছি সংসারের সচ্ছলতা আনতে, ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে। এতো পরিশ্রম করে তাও তো পারছি না। এসব ভেবে এখন তো চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। 


শিল্প পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, গাজীপুরে ছোট, মাঝারী ও বড় ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে প্রায় ৫হাজার। এতে কর্মরত আছেন ২৫লাখ শ্রমজীবি। যাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। সংসারের সচ্ছলতা আনতে তারা নিজ এলাকা ছেড়ে গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কাজে এসেছিলেন। এতোদিন ভালো চললেও করোনা মহামারী ও পরে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির কারণে তাদের জীবন যেন এখন আটকে যাচ্ছে। সামনের কথা ভেবেই যত দুশ্চিন্তা কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে। গাজীপুরের কয়েকটি কারখানা ঘুরে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে এমন চিত্র দেখা গেছে। 


শ্রমিকদের ভাষ্য, হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে জীবনযাত্রা ব্যয়। এই ব্যয়ভার বহনে বেতনের পর ওভারটাইম ছিল তাদের মূল ভরসা। জ্বালানী সংকটে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ শিফট বন্ধ করে দেয়ায় এখন সেটিও বন্ধ। বাজারের যে অবস্থা তাতে এক বেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। সবকিছুই তো কিনে খেতে হয়। স্বজন ছেড়ে দুর এলাকায় থাকায় তাদের খবরও কেউ নেয় না। এসব শ্রমিকদের আয়ের একটি অংশ মাসের বেতনের পর চলে যেতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের স্বজনদের কাছে। তাদের আয়ে সেখানকার গ্রামীন অর্থনীতিও সুফল পেতো এখন তো সে উপায়টিও বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এমন দুরাবস্থার পরও দেশের কেউ এগিয়ে না আসায় তারা হতাশ। এদিকে অধিকাংশ শ্রমিকরা গাজীপুরের স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ায় সরকারের নানা সহায়তাও তারা পাচ্ছেন না। 


বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন গাজীপুর মহানগর শাখার সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, দেশের চরম অর্থনীতি সংকটের মুখে এখন সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে শিল্প কারখানার শ্রমিকরা। দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় একটু ভালো খাবারও তারা খেতে পারছে না। একবেলা খেলে আরেকবেলা না খেয়ে থাকতে হয়, তারা অনেকেই অপুষ্টিতে ভোগছে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে অনেকেই আত্নহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। জ্বালানি সংকটে ওভার টাইম বন্ধ হয়ে গেছে। সাব-কন্ট্রাকের ছোট ছোট শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। একজন মানুষের একমাসে চলার উপযোগী বেতনও শ্রমিকরা এখন আর পাচ্ছে না। জরম্নরী ভাবে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা না হলে এসব শ্রমিকদের জীবন সংকটে পড়বে। 


বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুরে চরম গ্যাসের সংকট চলছে। সন্ধ্যার পর গ্যাসের চাপ কমে আসায় কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়। প্রতিটি কারখানায় গ্যাসের চাপ কম গত কয়েকমাস ধরেই। এই চাপে সব মেশিন ও জেনারেটর চালানো সম্ভব হয় না। একটি কারখানায় গ্যাসের চাপ প্রয়োজন ১৫পিএসআই। বিকেলের পর যা পাওয়া যায় না। এর ফলে কারখানায় উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। সাথে সময়মতো দিতে না পারায় অনেক অর্ডার বাতিল হচ্ছে। এতে কারখানার পাশাপশি শ্রমিকরা ক্ষতির মুখে পড়েছে।


গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি এইসব শিল্পকারখানার শ্রমিকরা। দেশের জ্বালানি সংকটে হয়তো তারা সমস্যায় পড়েছেন। তবে আমাদের সরকার মানবিক। জেলায় ইতিমধ্যেই সরকারের নানা খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী চলমান(৩০টাকা কেজি করে চাল) সেখান থেকেও তারা সহায়তা পেতে পারে। 

জেবি/ আরএইচ/