কৃষকদের কাছে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর চাবিকাঠি ভুট্টা চাষ
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:৩৩ পূর্বাহ্ন, ১৫ই নভেম্বর ২০২২
রুহুল আমিন, ডিমলা (নীলফামারী)
উত্তরের দীবেষ্টিত নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য বালু চর। এসব চরাঞ্চলের কৃষকরা ভুট্টা চাষে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন। চরাঞ্চলের কৃষকদের কাছে ভুট্টা যেন গুপ্তধন ও অমূল্য সম্পদ, ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর চাবিকাঠি স্বপ্নের এই ফসল বুনতে শুরু করেছেন চরাঞ্চলের কৃষকেরা।
রবিবার (১৩ নভেম্বর) উপজেলার টাপুর চর, ঝিনঝির পাড়া, ঝাড়সিংহেশ্বর, কিসামত ছাতনাই, বাঘের চর, পূর্ব খড়িবাড়ী, বাইশপুকুর, ফরেস্টের চরসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে সরেজমিনে দেখা গেছে কৃষকদের ভুট্টা রোপণের প্রতিযোগিতা। সামান্যতম সময় নেই তাদের হাতে।
জানা যায়, কয়েক দশক পূর্বে তিস্তা নদীর গতিপথ বদলের কারণে বিস্তীর্ণ এলাকায় চর জেগে উঠে। চরের ধু-ধু বালুতে কোনো প্রকার কৃষি আবাদ হতো না। বেশির ভাগ অনাবাদি থাকায় এলাকার মানুষ ছিল হতদরিদ্র ও মঙ্গা পিরিত। বালু/অনাবাদি বলে জমিও কেউ কিনতে চাইত না। ফলে চরাঞ্চলের কৃষকদের অভাব লেগেই থাকত।
বিগত কয়েক বছর পূর্বে উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে চরাঞ্চলের কৃষি জমিতে পরীক্ষামূলক ভাবে ভুট্টা চাষ শুরু করেন মাঠ পর্যায়ের কৃষকেরা। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে চলতি বছর উপজেলায় চরাঞ্চলসহ ১৩৪৫৮ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৩০৮ হেক্টর বেশি।
পূর্ব ঝাড়সিংহেশ্বর গ্রামের কৃষক শরিফ উদ্দিন মোল্লা বলেন, অন্য ফসলের চেয়ে খরচ কম হওয়ায় জমিতে ভুট্টা চাষ করি। এতে বেশি লাভবান হওয়া যায়। আমি পাঁচ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করলে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান হয়। অন্যদিকে এক বিঘা জমিতে ভুট্টা হয় ৩০ থেকে ৩৫ মণ। ভুট্টা চাষে সেচ কম লাগে, সারের ব্যবহারও কম। আবহাওয়া ভালো থাকলে গত বছরের মতো এবারও ভুট্টার বেশি ফলন হবে।
চরখরিবাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুল আলিম বলেন, প্রথম বছরে এক একর জমিতে ৮-১০ মণ ভুট্টা চাষ হয়। সেই জমিতেই পরের বছর ৩০-৪০ মণ ভুট্টা চাষ হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে ভুট্টার ফলন। বর্তমানে এই এলাকায় প্রতি একরে ১২০ থেকে ১৩০ মণ ভুট্টা চাষ হয়।
চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষ বেশি হওয়ার কারণে শ্রমিকের হাতে সারা বছরই কাজ থাকছে। ভুট্টার ক্ষেত প্রস্তুত, নিড়ানি ও সেচ দেয়াসহ বিভিন্ন কাজ করেন স্থানীয় শ্রমিকেরা। এ ছাড়া ভুট্টা বড় হলে তা ক্ষেত থেকে সংগ্রহ, মাড়াই, বাছাই, শুকানোসহ নানা কাজে বছরজুড়ে এই এলাকার শ্রমিক ব্যস্ত থাকেন। ভুট্টা থেকে আলাদা করা মোচা ও ভুট্টার গাছ এখন জ্বালনি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক বছরে নারীরাও ব্যাপকভাবে এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। নারী শ্রমিক দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন।
পূর্ব ছাতনাই ইউপি চেয়্যারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, কয়েক বছর পূর্বেও চরাঞ্চলের মানুষ অভাবের কারণে শিশুদের স্কুলে না পাঠিয়ে গৃহস্থালি কাজে লাগিয়ে দিতো। এখন আর তাদের অভাব নেই। এখন শতভাগ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। ভুট্টা চাষ লাভজনক হওয়ায় চরাঞ্চলে তামাক চাষ কমেছে। অনেক কৃষক তামাকের পরিবর্তে এখন ভুট্টা চাষ করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সেকেন্দার আলী জানান, প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই আসে ভুট্টা থেকে। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও থাকে সারাবছর। মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ১২-১৫ শতাংশ। এ তিন খাতে বছরে ৫০-৫৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে। যার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে মানুষের খাওয়ার উপযোগী মিষ্টি ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাষিদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে উঠেছে ভুট্টার আবাদ।