কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস

রামগঞ্জ প্রতিনিধি: শীত মৌসুম শুরুর সাথে সাথে গ্রাম বাংলার অজো পাড়া-গাঁয়ে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ থেকে সুস্বাদু রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হতে দেখা যায় কৃষকদের। হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর রসের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশা ‘গাছি’। কিন্তু গাছ থাকলেও গাছি তেমন দেখা যায় ন। অনেকের মতে এই পেশা মৌসুমী হওয়ায় এবং গাছ কমে যাওয়া এ পেশায় গাছিদের সংখ্যা কমে গেছে। ফলে রসের সঙ্গে হারাতে বসেছে খেজুর গাছ সম্পৃক্ত পেশা-গাছি।

একসময়ে শীত মৌসুমের শুরুতেই ভোরের কুয়াশা অতিক্রম করে গ্রামগঞ্জের গাছিরা কাছি (মোটা দড়ি), বেতের ঝুড়ি কোমরে বেঁধে ছুটে চলতেন গ্রামের পথ থেকে পথে। ঝুড়ির ভেতরে থাকত কয়েক রকমের গাছ কাটা দা (ছেন দা), বালি রাখার চুঙ্গা, রসের হাঁড়ি বা ঠিলা এমনকি দায়ে ধার দেয়ার বিভিন্ন প্রকারের দা। শীতের শুরুতেই গাছ ছিলানো (গাছ কাটা) নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গাছিরা। গাছের উপরে উঠে নিজেকে কোমরের কাছিতে বেঁধে তারপর চলত গাছ কাটা। কে কার আগে খেজুর গাছ কেটে রস নিয়ে বিক্রি করতে পারবে এর প্রতিযোগিতা চলত। খেজুর রসে তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েশ ছিল এ অঞ্চলের মানুষের নবান্নের সেরা উপহার।কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় শীত কালীন ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস। এমন এক সময় ছিল গোটা শীত মৌসুমজুড়ে রসের পিঠা,পায়েস,গুড় তৈরি হত ঘরে ঘরে। 

শীত আসার সাথে সাথে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ত কৃষকরা। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে একদিকে যেমন খেজুর গাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে, অন্যদিকে অভিজ্ঞদের অভাবে গাছ ছেলা প্রায় বিলুপ্তির পথে। হঠাৎ চলার পথে দেখা গেল রামগঞ্জ উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে  রাস্তার ২’পাশে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত আঃ খালেক হাওলাদার(৪৫) কে। তিনি জানান, হারানো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে তিনি এবছর, নিজের ও অন্যেরসহ মোট ৪০-৫০টি গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করবেন। ইতিমধ্যে প্রায় ২০টি প্রস্তুত করেছেন। গাছ ছেলা থেকে রস সংগ্রহ পর্যন্ত ১০থেকে ১২ দিন সময় লাগে। বিশেষ কৌশলে বাঁশের তৈরি খিল- চুঙ্গি বসানোর পর মাটির হাড়ি পেতে সুস্বাদু এ রস সংগ্রহ করা হয়। গাছ থেকে রস বের করতে প্রতিদিন গাছের কিছু অংশ ছেঁচে ফেলা হয়। একাধারে ৩ দিন কান্ড শুকানোর পর পুনরায় পালাক্রমে রস সংগ্রহ করা হয়। তিনি আরো জানান, গড়ে প্রতিটি গাছ থেকে ৩লিটার রস পাওয়ার আশা করছেন, বর্তমানে খেজুর রসের চাহিদা অনেক বেশি। 

দরদাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৫লিটারের প্রতি কলস সাড়ে ৪ থেকে ৫’শ টাকায় এবং প্রতি কেজি গুড় ১৪০-১৫০টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। একই গ্রামের আরো কয়েকজন এবছর খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করবেন বলে জানান, ইউসফ খান, ছালাম মৃধা ও নাসির খান। এ ব্যাপারে রামগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার জানান, রাস্তার পাশে, জমির আইল, পরিত্যাক্ত জমিতে বিনা পরিচর্যায় যে কোন ধরনের মাটিতে এ প্রজাতির গাছ ভালো জন্মায়। তিনি কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল আরব জাতের পাশাপাশি দেশীয় খেজুর গাছ রোপন করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে রস ও গুড়ের চাহিদা পূরণ ছাড়াও খেজুর রস বিক্রি করে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়া যায়। অপরদিকে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে মাদুর সহ বিভিন্ন কুটির শিল্পের কাজ করা ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু আগের মতো গ্রাম্য রাস্তার দু’পাশে সারি সারি খেজুর গাছ আর নেই। গ্রামের রাস্তা গুলো সংস্কার ও নতুন করে খেজুর গাছ রোপনে মানুষের আগ্রহের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনও বাড়ির উঠানের আশেপাশে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু খেজুর গাছ। আর রস আহরণে এখনো গ্রাম্য রীতিতেই ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি বেঁধে শীতের বিকালে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি গাছে বেঁধে তা থেকে রস সংগ্রহ করছে গাছিরা। আগে তারা এই কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। আবার কেউ কেউ সকালে রস জ্বাল দিয়ে গুড়-মিঠাই তৈরি করতো। প্রতিবছর এই মৌসুমে অযতেœ অবহেলায় পথে প্রান্তরেও পরে থাকা খেজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে এ সময়ে দুটো টাকা বাড়তি আয় করতো তারা।

গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, কয়েক বছর আগেও শীত মৌসুমে খেজুর রসের তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েসসহ সুস্বাদু নবান্নের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে উৎসাহ ও আনন্দের মধ্যে আমরা নবান্নকে বরণ করতাম। এখন আর খেজুর রস না পাওয়ায় নবান্নের আনন্দ থেকে বঞ্চিত আমরা। শীত মৌসুমে অতিথিদের রসের তৈরি পায়েশ দিয়ে আপ্যায়ন করানোর প্রচলন এখন ভুলতেই বসেছেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ।

কয়েকজন গাছি জানান, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে তাতে এক সময় হয়তো আমাদের এলাকায় খেজুর গাছ দেখাই যাবে না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কারণ নতুন করে খেজুর গাছ রোপনে মানুষ আগ্রহী হচ্ছে না। তালগাছ রোপনের মত খেজুর গাছ রোপনে সরকারী-বেসরকারী প্রচারণা থাকলে খেজুর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারত, না হলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর গাছের রস, হারিয়ে যাবে গ্রাম বাংলার আরো একটি ঐতিহ্য। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর গাছের রস। শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে রস সংগ্রহের প্রস্ততিতে ব্যস্ত থাকেন গাছিরা। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি এক ধরনের শিল্প। এর জন্য দরকার হয় বিশেষ দক্ষতা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল,রয়েছে ধৈর্য। খেজুরের রস থেকে বিভিন্ন রকমের গুড় তৈরি করে থাকেন গাছিরা। দিন দিন এই শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। এই শিল্প পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন সকলে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসা।