বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী হারিকেন
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
পাইকগাছা প্রতিনিধি: হারিকেন বা কুপিবাতি গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি অন্যন্য প্রতীক। শৈশব জীবনে বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের আলোর চাহিদা মিটানো বা অন্ধকার দূর কারার একমাত্র অবলম্বন ছিল হারিকেন বা কুপিবাতির আলো। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই হারিকেন আজ বিলুপ্তির পথে।
বাঙালির জীবনে রাতের অন্ধকার দূর করতে এক সময় দেশের গ্রামের মানুষের অন্যতম ভরসা ছিল হারিকেন, কুপি ও হ্যাজাক বাতি। যার অন্যতম জ্বালানি উপাদান ছিল কেরোসিন। তখনকার সময় এ সব জ্বালিয়ে গ্রামাঞ্চলে রাতে বিয়ে-সাদি, যাত্রাগান, মঞ্চ নাটক, ওয়াজ মহাফিল কিংবা বাড়িতে দোয়ার অনুষ্ঠান করা হতো। হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির ঊঠানে কিংবা ঘরের বারান্দায় ভাই-বোন একসাথে পড়াশোনা করতো। হারিকেনের জ্বালানি উপাদান কেরোসিন আনার জন্য কাচের বোতল ছিল। যা রশি দিয়ে বেঁধে রান্নাঘরের কোন স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সন্ধ্যার আগেই হারিকেনের কাঁচ মুছে তেল ভরে জ্বালানো হতো। হারিকেন হলো টিনের তৈরি দুটো খুঁটি, কাচের চিমনি বিশিষ্ট প্রদীপ। আনারসের মতো দেখতে কাচের চিমনির নিচের অংশ টিনের তৈরি তেলের ট্যাংক থাকত। যেখানে কেরোসিন তেল ঢালা হতো। মাঝখানে থাকতো ফিতে, গ্রামবাংলায় বলা হতো পলতে পা সলতে। যার এক চতুর্থাংশ ট্যাংকের তেলে মধ্যে চুবানো থাকতো। আর বাকি অংশ থাকতো উপরে কাচের মধ্যে। দিয়াশলাই কিংবা আগুন দিয়ে জ্বালালেই জ্বলেই আলো ছড়াতো। ট্যাংকারের পাশে থাকা রেগুলেটর দিয়ে আলো বাড়ানো কমানো হতো।
গ্রামের ইতিহাসে অন্ধকার রাতে হারিকেনের মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে পথচলার স্মৃতি কার না মনে পড়ে। এপাড়া থেকে ওপাড়া যেতে, হাটে বাজারে, পথ চলায় কিংবা তৎকালে প্রাণের স্বামী হাট-বাজার থেকে ফিরতে রাত হলে স্ত্রী হারিকেন হতে পথ পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন কিংবা আছেন যারা তাদের অনেকেই এই হারিকেন কিংবা কুপির মৃদু আলোর সাহায্যে লেখাপড়া করেছেন। ব্যবসা ও গৃহস্থালির কাজেও হারিকেনের ব্যাপক চাহিদা ছিল। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ‘ডাক হরকরা’ গল্পের নায়ক তার এক হাতে হারিকেন আর অন্য হাতে বল্লভ নিয়ে রাতের আঁধারে ছুটে চলে তার কর্ম পালনে। একসময় ডাক পিয়নরা চিঠির বোঝা পিঠে করে হাতে হারিকেন নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছুটে চলতো। কিন্তু সমাজ পরিবর্তন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে।
বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার ও সৌর বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে সেই হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না। উপজেলার গ্রামাঞ্চলে এখন হারিকেন যেমন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর তেমনি বিদ্যুৎ নেই এমন গ্রাম ও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে হারিকেনের জায়গা দখল করে নিয়েছে সৌর বিদ্যুতের আলো বা চার্জার লাইট। গ্রামাঞ্চলে এখনও দু-এক বাড়িতে হারিকেন পাওয়া গেলেও দেখা যাবে ব্যবহার না করায় সেগুলোতে ময়লা ও মরিচা পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
কাশিমনগর গ্রামের সমাজসেবক এম বুলবুল আহম্মেদ বলেন, ছোটবেলায় আমরা ল্যাম্প কিংবা হারিকেনের মৃদু আলোয় লেখাপড়া করেছি। বাতাসের ঝাপটায় কখনও কখনও আলো নিভে গেছে। আবার দিয়াশলাই অথবা চুলার আগুনে পাটকাঠি দিয়ে আলো জ্বালিয়েছি। তিনি আরো বলেন, হারিকেনের আলো মুদৃ হলেও সেই সময় শিক্ষার্থী ও বায়োজ্যেষ্ঠদের চোখের তেমন সমস্যা হতো না। কিন্তু আজ বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে শিশু ও প্রবীণদের চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন শুধুই স্মৃতি। নতুন প্রজন্ম হয়তো হারিকেন সম্পর্কে জানবে না, পড়তে হবে ইতিহাস। হয়তো এক সময় হারিকেনের দেখা মিলবে জাদুঘরে। সমাজ পরিবর্তন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় চর অঞ্চলের সেই ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে। বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার ও বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না।