ভয়াবহ জালিয়াতি; চট্টগ্রামে এক টিআইএন সনদে ১৯৩ গাড়ির নিবন্ধন
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বিআরটিএতে (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) রেজিস্ট্রেশন নেওয়া গাড়ির তথ্য যাচাই করে এক টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) দিয়ে ১০৩টি গাড়ি নিবন্ধন জালিয়াতি চক্রকে সনাক্তের পর নতুন করে এক টিআইএন সনদ দিয়ে আরও ১৯৩টি গাড়ি নিবন্ধনের প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল। এসব গাড়ির মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির পাশাপাশি দেশের স্বনামধন্য পাঁচ থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের গাড়িও রয়েছে। গাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে বিআরটিএ’র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল। এদিকে এক টিআইএনে একাধিক গাড়ি নিবন্ধনের দায় ওই টিন সার্টিফিকেটধারীকেই দিচ্ছে চট্টগ্রাম বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের।
এক টিআইএন সনদে ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রেবাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন ধরণের ১৯৩টি গাড়ি নিবন্ধন করা হয়েছে। এই জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি টিআইএন সনদধারী মূল ব্যক্তিও রীতিমত বিপাকে পড়ছেন, হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কর অঞ্চল ও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এরআগে তানিয়া জেসমিন নামে মহিলার টিআইএন ব্যবহার করে ১০৩টি গাড়ি বিভিন্ন ব্যক্তির টিআইন সনদ ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করার প্রমাণ পায় চট্টগ্রাম কর অঞ্চল।
গত ২০ সেপ্টেম্বর জাল টিআইএনে গাড়ি রেজিস্ট্রেশন বন্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ বা এনবিআর) ও বিআরটিএ সমঝোতা চুক্তি সই করে। এ চুক্তির ফলে এনবিআর বিআরটিএ’র ডাটাবেজে রক্ষিত গাড়ির মালিকের নাম, ঠিকানা, টিআইএনসহ যাবতীয় তথ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছে। চট্টগ্রাম কর অঞ্চল এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম বিআরটিএতে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া গাড়ির তথ্য যাচাই করে এক টিআইএন দিয়ে একাধিক গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের প্রমাণ পেয়েছে। চট্টগ্রামে এক টিআইএন সনদেই ১০৩ গাড়ি নিবন্ধন।
সূত্র জানায়, সাধারণ একজন মানুষের টিআইএন সনদ ব্যবহার করে ১৯৩টি গাড়ি নিবন্ধন করা হয়েছে। এই জালিয়াতির খপ্পড়ে দেশের স্বনামধন্য পাঁচ থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের গাড়িও রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বিআরটিএর নির্ধারিত ফরমে গাড়ি নিবন্ধনের আবেদন করতে হয়। সব তথ্য যাচাই শেষে আবেদনকারীকে রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দিতে হয়। তারপর গাড়ি পরিদর্শন করিয়ে মালিকানা ও প্রয়োজনীয় তথ্য বিআরটিএ ইনফরমেশন সিস্টেমে অন্তর্ভূক্ত করতে হয়। গাড়ি নিবন্ধনের অনুমতি পাবার পর নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ট্যাক্স টোকেন প্রিন্ট করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরসহ গ্রাহককে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই টিআইএন সার্টিফিকেট দিতে হয়। অথচ বিআরটিএর কিছু দালালচক্র এক টিআইএন সনদে একাধিক গাড়ি নিবন্ধন পাইয়ে দেয়ার সাথে জড়িত রয়েছে। এতে বিপাকে পড়ছেন টিআইএন মূল সনদধারী।
চট্টগ্রাম কর অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এক টিআইএন সনদে একাধিক গাড়ি নিবন্ধনের কারণে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই জালিয়াতির সাথে অবশ্যই বিআরটিএর দালালচক্র জড়িত রয়েছে। এসব জালিয়াতিচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম কর অঞ্চলের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘গাড়ি নিবন্ধনের পর বিআরটিএ গাড়ি সংক্রান্ত সব ধরণের তথ্য তাদের অনলাইনে রাখে। তাহলে এসব জালিয়াতির বিষয়টি প্রথমে তাদের নজরে পড়া উচিত ছিল। তবে শেষমেষ বিষয়টি ধরা পড়েছে, এটাই আসল ব্যাপার। একটি টিআইএন সনদ ব্যবহার করে ১৯৩টি গাড়ি নিবন্ধন করা হয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির পাশাপাশি দেশের নামিদামি পাঁচ থেকে ছয়টি কোম্পানির গাড়িও আছে। আমরা টিআইএন মূল সনদধারীর সাথেও কথা বলেছি। অথচ তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। আমরা ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএকে চিঠি দিয়েছি। এই জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরণের অপরাধ করতে কেউ পুনরায় সাহস করতে না পারে।’
এদিকে এক টিআইএনে একাধিক গাড়ি নিবন্ধনের ভুলটা গ্রাহকের উল্লেখ করে বিআরটিএ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এনবিআর ও বিআরটিএর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে একটা চুক্তি হয়েছে। এর ফলে মূল টিআইএন নম্বরধারী তার ওই নম্বরে টাকা জমা দিবেন। নাম ঠিক না থাকলে সে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারবে না। এখন সব অনলাইনেই হচ্ছে। আগে একজন গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গিয়ে যদি খামখেয়ালিপনায় আরেকজনের টিআইএন নম্বরে টাকা জমা দেয়, তাহলে সে দায়ভার তো গ্রাহকেরউপর বর্তাবে। এখন আয়কর রিটার্নের ব্যাপারে এনবিআর কঠোর অবস্থানে আছে। তাই বিআরটিএ দুটি সফটওয়্যার আপডেট করেছে। এখন অন্য টিআইএন নম্বরে টাকা জমা দেয়ার সুযোগ নেই।’
আইনে বলা আছে, আয়কর অধ্যাদেশে জাল টিআইএন ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর ওপর আর্থিক জরিমানাসহ কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১২৪এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের টিআইএন অথবা জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা আয়কর আইন অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে টিআইএন ব্যবহার বাধ্যতামূলক, সেসব ক্ষেত্রে জাল টিআইএন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে।
অন্যদিকে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেবা দেয়ার সময় টিআইএন ভেরিফিকেশন না করলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪এএ ধারা অনুযায়ী সেবা প্রদানকালে টিআইএন সনদ যাচাই না করলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে আয়কর বিভাগ। ১৬৫এ ধারা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনো ব্যক্তি জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা অন্যের টিআইএন ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।