গুজব থেকে সচেতন হই


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


গুজব থেকে সচেতন হই

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলাআরও দশদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই চলছিল ২ মার্চ ২০১৩ দিবাগত মধ্যরাত পর্যন্ত  সবকিছু। হঠাৎ করে কিছু দুষ্কৃতকারী চারিদিকে ছড়িয়ে দিলো চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে। মুহুর্তে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো এ ঘটনা। চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে, কিন্তু কে দেখেছে তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। এ নিয়ে সৃষ্ট দাঙ্গায় ১৩ জন নিরীহ মানুষ মারা গেলেন, আহত হলেন অনেকে। বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হলো। দেশব্যাপী ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হলো। অথচ একটি বারও কেউ ভেবে দেখলো না বাস্তবে কোন ব্যক্তিকে চাঁদে দেখা সম্ভব কি-না। কিছু দুষ্কৃতকারীর দুষ্কর্মে অনেক মানুষের ক্ষতি হয়ে গেলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হলেও কোনোভাবেই ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হলো না। এ গুজব যারা রটিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলা করলেও সে মামলা আজও নিষ্পত্তি হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ন্যায় বিচার এখনো পায়নি।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে উগ্রধর্মান্ধ গোষ্ঠী অগ্নি সংযোগ ও হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছিলো কক্সবাজারের রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ও আশপাশের বসতি। ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এক বিরান ভূমিতে পরিণত করে এলাকাটিকে। উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডিতে পবিত্র কোরআন শরীফের অবমাননার ছবি পোস্ট করা হয়েছিল পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনের দাঙ্গায় অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু যারা এই দুষ্কর্মটি করেছিলো একবারও তারা ভেবে দেখেনি এটা সত্যি না মিথ্যা।

২০১৬ সালের নাসিরনগরের ঘটনাও একই রকম। রসরাজ নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডি থেকে ইসলাম বিদ্বেষী এক পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার সূত্রপাত। ৫টি মন্দির ও ৮টি হিন্দুপাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছিলো। পরবর্তীতে দেখা গেলো রসরাজ একজন নিরক্ষর দরিদ্র  মানুষ,  ফেসবুক কি তা-ই তিনি জানেন না। সবগুলো ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে সমর্থ হলেও বন্ধ করতে পারেনি।

এরও আগে পদ্মাসেতু নির্মাণের শুরুতে গুজবের শেষ ছিলোনা। প্রতিদিন কোন না কোন গুজব শুনা যেতো। করোনাকালে অর্থাৎ আগস্ট ২০২০ সালে হঠাৎ গুজব রটলো পদ্মাসেতুতে শিশুর কাটা মাথা ও রক্ত লাগবে। সেতুর আশেপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। পরবর্তীতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং ব্যপক প্রচারের ফলে জনমনে স্বস্তি ফিরে এলো।  
 
করোনা নিয়েও কম গুজব ছড়ায়নি। করোনা টিকা নিলে মানুষের ডিএনএ পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং বন্ধ্যাত্ব ডেকে আনতে পারে  এরকম একটা গুজব সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। এছাড়া দেশি-বিদেশি বিখ্যাত ডাক্তারের নামে করোনার নানারকম চিকিৎসাপত্র ও উপদেশ সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা দেখেছি। এসব ব্যবস্হাপত্র ঐ সকল ডাক্তারদের না, এমনটা অনেকেই পত্রিকায় জানিয়েছেন। ৬ মার্চ ২০২১ সালে আরও একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেটি হলো সরকার করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের প্রত্যয়ন লাগবে। এ গুজবটি সোসাল মিডিয়ার পাশাপাশি ইউটিউবে দেওয়া হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারণে এটি বেশিদূর এগোতে পারেনি।

উপরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গুজব দুই ধরনের লোকের মাধ্যমে ছড়ায়। একধরনের লোক খুবই দুষ্ট প্রকৃতির। তারা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এই ঘৃণ্য পথটি বেছে নেন। এর মাধ্যমে সমাজ বা দেশের কি ক্ষতি হলো সেটা বিবেচনায় না এনে নিজের এবং তাদের লাভবান হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর অন্য এক ধরনের মানুষ আছে যারা বোকার মতো কোনো কিছু না বুঝেই এ ধরনের ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে পড়ে। এখানে তাদের সরাসরি কোনো লাভ হয়না বরং পরবর্তীতে ক্ষতি হয়।

গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য সাধারণত চারটি। রাজনৈতিক স্বার্থে, কোনো কনটেন্টকে ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে, টাকা কামানোর উদ্দেশ্য এবং ব্যক্তিস্বার্থে। সাধারণত ছয়টি উপায়ে গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। এগুলো হলো: ছবি সম্পদনা বা টেম্পারিং এর মাধ্যমে, বানোয়াট বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে, সত্য ঘটনার বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমে, নকল অথবা কাল্পনিক বিশেষজ্ঞ এর ভুয়া বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে, গণমাধ্যমের অপব্যবহারের মাধ্যমে এবং তথ্যের বিকৃতির মাধ্যমে। 

ছবি সম্পদনা বা টেম্পারিং এর মাধ্যমে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ানো হয়। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে হামলা, ২০১৬ সালে নাসিরনগরে মন্দিরে হামলাসহ বেশ কিছু দাঙ্গা  অসৎ উদ্দেশ্যে ছবি সম্পদনা করে ফেইক আইডি ব্যবহার করে সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে করা হয়েছিল। বানেয়াট বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিরোধী একটি চক্র অসৎ উদ্দেশ্যে বিদেশে অবস্থান করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নামে কুৎসা রটনার অপপ্রচারে লিপ্ত আছে। এটাও এক ধরনের তথ্য সন্ত্রাস। আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তারা এই জঘন্যতম মিথ্যাচারে লিপ্ত রয়েছে। সত্যের বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমেও গুজব ছড়ানো হয়। সাধারণত মানুষ  পুরো সংবাদটি পড়ে না, অধিকাংশ মানুষ সংবাদের হেডলাইনটি দেখে সাথে দুই একটি লাইন পড়ে। এখানে অসৎ উদ্দেশ্যে সংবাদের শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়,যা মূল সংবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। নকল অথবা কাল্পনিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করা হয়। করোনাকালে ভারতের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির নামে কোভিট-১৯ বিষয়ক পরামর্শ ফেসবুকে দেখা গেছে তার সবই গুজব। জনাব শেঠি সাংবাদিকদের নিজে থেকে জানিয়েছেন তিনি এ বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেননি। এছাড়াও চেনা বিশেষজ্ঞ অচেনা প্রতিষ্ঠানের হয়ে মতামত দেওয়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের কোনো অস্তিত্ব নেই বলা হয় জনৈক বিশেষজ্ঞ, আবার হয়তো বিশেষজ্ঞ সঠিক আছে মতামত বিকৃত, বিশেষজ্ঞের মতামতের ভুল অনুবাদের মাধ্যমে ও গুজব ছড়ানো হয়। গণমাধ্যমের অপব্যবহারের মাধ্যমে ও গুজব ছড়ানো হয়। মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার পরে অনেক গণমাধ্যমে তার ন্যায় বিচার নিয়ে নানারকম মন্তব্য এসেছিলো। ঠিক একইভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়েও অনেক গণমাধ্যমে সে সময় সঠিক তথ্য আসেনি। সর্বশেষ তথ্যের বিকৃতির মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়। এগুলো হয় সাধারণত গবেষণার পদ্ধতিগত বিকৃতির মাধ্যমে, ফলাফলের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে এবং অকার্যকর তুলনার মাধ্যমে।

গুজবের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে প্রভাবিত করে নিজের বা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করা। এখানে ন্যায় অন্যায় বিবেচনা করা হয় না। গুজবে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর সামন্য কিছু মানুষ অনৈতিকভাবে লাভবান হয়। এতে সমাজ ও দেশের ক্ষতি হয়।

তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে “কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়িলে বা দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ঠ বা অসৎ হতে উদ্ভুদ্ধ হতে পারেন অথবা যা দ্বারা মানহানি ঘটে বা ঘটার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন  হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয় তাহলে তার একাজ হবে একটি অপরাধ। আর এ অপরাধ করলে অপরাধীকে বিজ্ঞ আদালত অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন ০৭ বছর  কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। তাই সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়ক বেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে তখন ৩০ লাখ শহিদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে হাতেগোনা কয়েক জন দেশে-বিদেশে বসে আধুনিক প্রযুক্তিকে অপব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে দেশের ক্ষতি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। এরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে কখনোই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না এটাই হোক মুজিব শতবর্ষে আমাদের অঙ্গীকার।

ইমদাদ ইসলাম, পিআইডি ফিচার।  

এসএ/