আট মাসেও উদঘাটন হয়নি কিশোর জুয়েলের মৃত্যুর রহস্য
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:২৪ পূর্বাহ্ন, ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কবরবাড়িয়া গ্রামের জুয়েল নামের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সন্দেহের তীর জুয়েলের ৩ বন্ধু ও প্রেমিকার পরিবারের দিকে।
পরিবার সুত্রে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো সেদিনও বাবার সাথে বাড়ির কাজ করছিলেন কবরবাড়িয়া গ্রামের ছের আলীর ছোট ছেলে জুয়েল। গত ২০২২ সালের (০৩ জুলাই) বিকেলের দিকে হঠাৎ করে জুয়েলের ৩ বন্ধু কবরবাড়িয়া গ্রামের মাছুম বিশ্বাসের ছেলে রাতুল, একই এলাকার জয়নালের ছেলে জিসান ও মাহাবের ছেলে আলামিন এসে জুয়েলকে ডাক দিলে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সারা রাত অতিবাহিত হলেও সেদিন বাসায় ফেরেনি জুয়েল।
পরদিন ২০২২ সালের (০৪ জুন) সকাল সাড়ে ৭ টার সময় কবরবাড়িয়া বাইপাস সংলগ্ন ধানক্ষেতের মাঠের মধ্যে পাওয়া যায় জুয়েলের মরদেহ। জুয়েলের পুরো শরীরে ছিলো বিভিন্ন ধরনের ক্ষতের চিন্হ। পাশেই পরে ছিলো মাছ মারার গ্যাস ট্যাবলেট বিষ। পরে লাশটি উদ্ধার করে সুরতাহল রিপোর্ট করেন এবং লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে প্রেরন করেন মিরপুর থানা পুলিশের সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মাজহারুল ইসলাম। লাশটি ময়নাতদন্তের পর মিরপুর থানায় একটি ইউডি মামলা হয়। যার মামলা নং -২১। সেই ইউডি মামলাটি তদন্তের আয়ু হিসেবে দায়িত্বপান মিরপুর থানার সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান। সে সময় নিহত জুয়েলের পরিবার বাদী হয়ে মামলা করতে গেলেও মামলা নেয়নি মিরপুর থানা পুলিশ।
মামলাটির তদন্তকারী অফিসার সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান গত ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর কুষ্টিয়ার বিজ্ঞ আদালতে চুরান্ত রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্টে উল্লেখ্য করেন নিহত জুয়েল তার পরিবারের নিকট ২৮ হাজার টাকার দামের টাচ মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়ায় তার পরিবারের প্রতি অভিমান করে গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে মৃত্যুবরন করেছেন। এ ছাড়াও নিহত জুয়েলের পরিবার লোকজনসহ নিকট আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিদের এই মৃত্যুতে কারো কোন দায়/অপরাধ সহায়তা বা প্ররোচনা অস্তিত্ব পাওয়া যায় নাই এবং জুয়েলের পিতা ছের আলী সহ কারো কোন অভিযোগ নাই। এতে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এ নিয়ে শুরু হয় নানান ধরনের জল্পনা কল্পনা।
এদিকে সন্তানের রহস্যজনক মৃত্যুর সঠিক ঘটনা উদঘাটন না হওয়ার কারনে নিহত জুয়েলের পিতা ছের আলী খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি। পরে ২০২৩ সালের (২৭ জানুয়ারী)সকাল ১০ টার সময় কুষ্টিয়া সদর পুলিশ সার্কেল অফিসে নিহত জুয়েলের পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনা হয়।
নিহত জুয়েলের পরিবারের মুখ থেকে সমস্ত ঘটনা শোনার পর মামলাটি পুনরায় তদন্ত শুরু করেছেন কুষ্টিয়ার সদর সার্কেলের কর্মরত পুলিশ।
নিহত জুয়েলের মা রেবেকা খাতুন বলেন, সারাদিন আমার ছেলের সাথেই আমি ধান মাড়াই করেছি। ধান মাড়াই করার পরে ৪ টার সময় ৩ বন্ধু আসে আমার বাড়িতে। দুইজন আগে আসে। জিসান আর রাতুল। এসে আমার ছেলেকে কি বলে আমি জানতে পারিনি। তারপর আলামিন এসে আমার ছেলেকে হাত ধরে নিয়ে যায়। আমার ছেলে একটা প্যান্ট নিয়েছে একটা গেঞ্জি নিয়েছে। আমার ছেলকে ওরাই মেরেছে। আমার ছেলের লাশ মাঠে পাওয়া গেছে। আমি সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমার ছেলের জন্য সঠিক বিচার চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। আমার ছেলে কি অপরাধ করেছে। আমার ছেলেকে বন্ধুরা কেনো মারলো। ছোয়ার সাথে আমার ছেলে প্রেম করেছিলো ওই কারনে আমার ছেলেকে মেরে ফেলে দিয়েছে ওরা। থানায় গিয়ে বারবার মামলা করতে গেছিলাম থানা মামলা নেয়নি।
জুয়েলের পিতা ছের আলী বলেন, আমার ছেলে পাশের এলাকার ছোয়ার সাথে প্রেম করতো। আমার ছেলের এমন রহস্যজনক মৃত্যু হবার ৫ দিন আগে ছোয়ার চাচা লতিফ বিশ্বাস আমার ভাইয়ের ছেলের কাছে এসে বলে তোর চাচাতো ভাই আমারে ছোয়ার সাথে প্রেম মিলামেশা করছে। অবৈধ কথা বার্তা বলে এর পরে গেলেই কিন্তু ঠ্যাং ঠুং বাইড়ি ভাংগী ফেলবোনে। লতিফ তখন আমার বাড়ি এসে আমার কাছে বলে তোর ছেলের এত বড় সাহস আমাদের ছোয়ার সাথে প্রেম করে। তোর ছেলে মূর্খ। তোর ছেলে লেখাপড়া জানেনা। তোর ছেলে এবার গেলে কিন্তু ট্যাং ঠুং ভেংগে ফেলবোনে তখন কিন্তু কিছু বলতে পারবিনা। তাই বলে সে চলে যাওয়ার পর আমি কিছুক্ষন পর সেই মেয়ের বাড়িতে যাই। ওই মেয়ের মাকে বলি আমার জুয়েল কি করেছে।জবাবে মেয়ের বা বলে যা করেছে যা করছে আজ যদি মেয়ের বাপ বিদেশ না থাকতো তাহলে তোমার ছেলেকে আজকেই বাইড়ে মেরে ফেলতো। তারপর আমি চলে আসি।
এরপর ২০২২ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে আমি আর আমার ছেলে ধান মাড়াই করছিলাম। সেই সময় তার দুইটি বন্ধু আসলো রাতুল আর জিসান। এসে আমার ছেলেকে ডেকে নিয়ে পাশে কি কথা বললো আমার ছেলে বাড়িতে এসে একটা ব্যাগ নিয়ে বের হলো। তার কিছুক্ষনের মধ্যেই আলামিন নামের এক ছেলে আসলো আমাকে বললো কাকা আমরা আজকে পিকনিক করবো। তখন আমার ছেলে আমাকে বললো আজকে আমরা পিকনিক করবো রাতে বাড়ি আসবো না। আজকে রাতে আলামিনের ওখানেই থাকবো। পরদিন সকাল ৬ টার সময় আমি বিটিসিতে ডিউটি করার জন্য চলে যায়। প্রায় দেড় ঘন্টা পরে সকাল সাড়ে ৭ টার সময় আমার মোবাইল ফোনে একটি কল আসলো আমার ছেলে বাইপাসে এক্সিডেন্ট হয়েছে।
আমি সাথে সাথে বটতৈল মোড় হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বাইপাস হয়ে আসছিলাম৷ পরে মাঠের মধ্যে অনেক ভীর দেখে আমি মোটরসাইকেল রেখে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই মাছুম আমার হাত ধরে টেনে পাশে নিয়ে গিয়ে বলছে তুই লাশ দেখিস পরে আগে পাশে আই। তুই যদি এখানে কোন কথা বলিস এই মামলার বাদী হোস তাহলে তোর মেজো ছেলেকে আমরা মেরে ফেলবো। এই বলে আমাকে হুমকি ধামমি দিয়ে মাছুম আর আব্দাল মেম্বার আমাকে লাশের কাছেও যেতে দিলোনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পুলিশ চলে আসলো। পুলিশ এসে বললো এখানে বাদী কে? ।
মেম্বার তখন নিজেই বলছে স্যার এখানে কোন বাদী নেই আপনার যা করনীয় তাই করেন। পুলিশ লেখালেখি শেষ করে লাশ নিয়ে চলে গেলো। আমি বাড়িতে চলে আসার কিছুক্ষন পরেই মাছুম ও মেম্বার আমাকে থানায় পুলিশ ডাকছে বলে থানায় নিয়ে যায়। তখন আমাকে একটি কাগজে সই করতে বলে। বললো এই কাগজে সই না করলে লাশ ময়নাতদন্ত হবেনা। তখন আমি সই করে দিলাম। লাশ দাফনের পরের দিন আমার মেজো ছেলে আমাকে বললো তুমি থানায় সই করেছো কেনো। আমি উত্তরে বললাম তোকে মেরে ফেলার ভয় দেখানোর কারনেই আমি সই করে দিয়েছি। তারপর থানায় গেলাম মামলা করতে। থানা বললো কেস নেওয়া হবেনা। লাশ যেহেতু ময়নাতদন্ত হয়েছে এটা পুলিশ বাদী মামলা হয়েছে।
এটা তদন্ত শুরু হয়ে যাবে। মৃত্যুর ২৫ দিন পরেই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দিয়েছে। আমি থানায় ঘুরে ঘুরে আমাকে সেই রিপোর্ট দেয়নি পুলিশ। পরে কোর্ট থেকে রিপোর্ট তুলে আমি আবারো থানায় যেয়ে বললাম আমার ছেলে বিষ খায়নি আপনারা মামলা নেন। তখন তারা জানালো কোর্টে গিয়ে মামলা করেন আমাদের কিছু করার নাই। পরে আমি ডিআইজি স্যারের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পরে আবারো সেই মামলা তদন্ত শুরু হয়েছে। আমি সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমার ছেলের মৃত্যুর বিচার চাই।
এ বিষয়ে ছোয়া নামের মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে সাংবাদিকদের সাথে কোন কথা বলতে চাননি তারা।
ইউডি মামলার তদন্তকারী অফিসার সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমে কথা বললে তিনি জানান, অপমৃত্যু মামলা ফেলে রাখার কোন সুযোগ নেই এইটা ফাইনাল রিপোর্ট দিতে হয়। যদি কোন মামলার আবেদন পরে অথবা কোর্টে মামলা হয় তাহলে এটা পুনরায় তদন্ত শুরু হবে। সে সময় কেউ কোন অভিযোগ করেনি। পরে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরে নিহতের পরিবার এসেছিলো অনেক রকম কথা বলছিলো। তখন আমি ওসি স্যারের সাথে কথা বলেছিলাম, সার্কেল স্যারের সাথে কথা বলেছিলাম। কথা বলার পরে বলেছিলাম আপনারা কোর্টে একটা আবেদন করেন তাহলে পুনরায় তদন্ত হবে। পরে তারা ডিআইজি স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলো। এটা নিয়ে আবারো পুনরায় তদন্ত শুরু হবে। তখন কেউ অভিযুক্ত প্রমান হলে আসামী হবে।
কুষ্টিয়া সদর সার্কেল এসপি রাসেল হোসেনের সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশ সুষ্ঠুভাবে ব্যাপারটি তদন্ত করবে। পুলিশ সঠিকভাবে পুলিশের দায়িত্ব পালন করবে।
আরএক্স/