উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভুয়া বিল দেখিয়ে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাত
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আওতায় গত এবং চলতি অর্থ বছরে বিভিন্ন খাতে ভুয়া বিল দেখিয়ে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রমের ভ্যাকসিনেটর ও স্বেচ্ছাসেবকদের আপ্যায়ন, পরিবহণ, জনসচেতনতা মূলক সভা ও প্রচার-প্রচারণা এবং ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে মাদার সাপোর্ট গ্রুপের ওরিয়েন্টেশনের আপ্যায়ন ও স্টেশনারী ক্রয়ে এসব ভাউচার দেখানো হয়।
২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১মে পর্যন্ত ৬ দিনে ৭৮টি ভাউচারের মাধ্যমে ১২ লাখ ১৬ হাজার ৮০০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। যারমধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারিতে ২১ হাজার ৬০০ টাকা, ১৫ মার্চ ১৫ হাজার ৬০০ টাকা, ৩১ মার্চ ১৪ হাজার ৪০০ টাকা, ১৫ এপ্রিল ১৪ হাজার ৪০০টাকা, ১৮মে ১৫হাজার ৬০০ টাকা এবং ৩১মে ১২ হাজার টাকা ব্যয় দেখিয়ে উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিস থেকে এসব বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
ওই সময় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকাদান কার্যক্রমে একদিন অংশ গ্রহনকারীদের ৪০ জনের ৪০ প্যাকেট খাবারের মূল্য ২০ হাজার টাকা দেখিয়েও একটি বিল উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ভাউচার মতে, সে খাবার কেনা হয়েছে মরিয়ম হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট থেকে।
এ ভাউচারগুলো প্রসঙ্গে মরিয়ম হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের মালিক মোঃ মুকুল বকসী জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লোকজন তার কাছ থেকে তার স্বাক্ষর ও লেখা বিহীন ২০০টি ফাঁকা ভাউচার নিয়ে গেছেন। ওই ফাঁকা ভাউচারগুলো তারা কি কাজে ব্যবহার করেছেন তা তিনি জানেন না। তবে তারা কয়েকদিন ভাত-নাস্তা নিয়ে গেছেন এবং এক বছরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লাখ খানেক টাকার ভাত-তরকারি-নাস্তা সরবরাহ করেছেন বলে জানান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,সমস্ত ভাউচার গুলো একই হাতের লেখা এবং প্রত্যেকটি ভাউচারে শুধু টাকার অংক লেখা হয়েছে। তবে কি মালামাল ক্রয় করা হয়েছে তার কোন বর্ননা নেই।
ভাউচারগুলো দিয়ে বিগত ২০২১ সালের ৩ জুন রাজারহাট হিসাবরক্ষণ অফিসে বিল দাখিল করা হয় এবং যথারীতি বিলের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এছাড়া গত এক বছরের মধ্যে আপ্যায়নের নামে আরো কয়েক লাখ টাকার বিল উত্তোলনের অভিযোগও আছে।
শুধু আপ্যায়ন বিল নয়। ভ্যাকসিন ও লজিষ্টিকস পরিবহন ব্যয়, কোভিড-১৯ টিকাদান কাজে নিয়োজিতদের ভ্রমন ব্যয়, টিকাদান কার্যক্রমে অনিয়মিত শ্রমিকের মজুরী বিল,জাতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন-২১ উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবক ও মাঠকর্মীগণের ভাতা,মালামাল পরিবহন, স্যানিটাইজার ক্রয়, পোর্টারের মজুরী বিল, সমন্বিত পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ষ্টেশনারী মালামাল ক্রয়, পাবলিক এ্যাড্রেস সিস্টেম, শিশু বান্ধব হাসপাতাল প্রশিক্ষানাথীদের ভাতা, সার্টিফিকেট ব্যানার তৈরী, হাসপাতালের বর্জ্য অপসারণ সহ বিভিন্ন খাতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিলসহ এভাবে বিভিন্ন কর্মকান্ডে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ এসেছে রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল এর বিরুদ্ধে। এসব বিলের বেশিরভাগে নেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাব শাখার কর্মকর্তার স্বাক্ষর।
২০২১ সালের ২৪ জুন তারিখ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে কোভিড-১৯ নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারনার ব্যয় দেখিয়ে ১ লাখ ৬৮হাজার টাকা, আলোচনা সভার আপ্যায়ন ব্যয়ের নামে ৩৯হাজার ২০০টাকা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্রয় দেখিয়ে ২৪ হাজার টাকা বিল উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিস থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
একই সময় কোভিড-১৯ রোগীর নমূনা সংগ্রহ ও জেলায় প্রেরন এর পরিবহন ব্যয় দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ৬১ হাজার ৮০০ টাকার পৃথক বিল।
অন্যদিকে ৭জুন ভ্যাকসিন পরিবহন ব্যয় দেখিয়ে ৪২ হাজার টাকার ১টি, ৩৬হাজার ৪০০টাকার ১টি, ৮০হাজার ৫০০টাকার ১টি, ৮৪হাজার টাকার ১টি সহ বিভিন্ন সময় পরিবহন ব্যয়ের নামে কয়েক লক্ষাধিক টাকার বিল উত্তোলন করা হলেও উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্ব প্রাপ্তগণ দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য।
তারা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সহ অন্যান্য সকল প্রকার ভ্যাকসিন টিকাদান কেন্দ্র গুলোতে ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারের মাধ্যমে বহন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থনৈতিক কোড-৩২৫৮১০৫ এর আওতায় এ্যাম্বুলেন্স মেরামত ও বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে তিন লাখ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে তাও বলতে পারেননা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্যানা কর্মচারীরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আবুল কালাম জানান,গত এক বছরে তার এ্যাম্বুলেন্সের কোন মেরামত বা যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়নি।
কোভিড-১৯ রোগীদের নমূনা সংগ্রহ ও জেলায় প্রেরনের ব্যয় দেখিয়ে অনেক টাকা বিল উত্তোলন করা হলেও মূলতঃ সমস্ত নমূনা ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারে করে স্বাস্থ্য কর্মীরা মোটরসাইকেলে বহন করে জেলায় প্রেরন করতো বলে তিনি জানান। একই ভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা খাতে (বরাদ্দ অর্থনৈতিক কোড-৩২১১১০২) বরাদ্দকৃত টাকার অধিকাংশই ভূয়া ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবিকা শান্তি রায় বলেন, কোভিড-১৯, ভিটামিন এ প্লাস বা অন্যান্য অন্যান্য কর্মসূচীর জন্য তিনি কোন ভাতা পাননি। একই কথা জানান সেবিকা তীর্থ রানী,নেওয়াজ সেলিনা সহ অন্যারা। অথচ এ বিষয়ে ভাতা ভাউচারে দেখানো হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান হিসাব রক্ষক কাম অফিস সহকারি আশরাফুল মজিদ জানান, কোভিড-১৯ কার্যক্রমের বিলগুলো আমার যোগদানের পূর্বের। মাদার সাপোর্ট ওরিয়েন্টেশনের বিলগুলোও আমার মাধ্যমে তৈরী করা হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কার মাধ্যমে বিল তৈরী করিয়েছেন তা আমার জানা নেই।
একই কথা বলেছেন,রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক হিসাব রক্ষক কাম অফিস সহকারী (বর্তমানে কুড়িগ্রাম সরকারি হাসপাতালে কর্মরত) আব্দুর রাজ্জাক। তাকে দিয়েও কোভিড-১৯ কার্যক্রমের বিল তৈরী করা হয়নি বলে তিনি জানান।
এতসব অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, কাজ করে বিল করা হয়েছে।
হিসাব সহকারি দিয়ে বিল না করার অভিযোগে বলেন, সবাই সব কাজ পারেনা। যে পারে তাকে দিয়ে করানো হয়। ফাঁকা ভাউচারের বিষয়ে বলেন আমাদের লোকজন এগুলো লেখে। দোকানদাররা তো বোঝেনা।
এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মনজুরএ-মোর্শেদ বলেন, আমি কিছুদিন আগে এখানে যোগদান করেছি। রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিষয়গুলো শুনেছি, খোঁজ খবর নিয়ে অভিযোগ সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
এসএ/