বেকারদের জীবন কোন দিকে?


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


বেকারদের জীবন কোন দিকে?

সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশন এর এক জরিপে জানা যায়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ তথ্য এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। করোনাকালে সারা দেশেই বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। আঁচল বলছে, আর্থিক টানাপোড়েন, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, অভিমান এসব কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এদিকে অনেকেই লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করতে না পেরেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

করোনাকালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। সম্প্রতি এনটিআরসি এর তৃতীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আওতায় প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৩৮ হাজার ২৮৩ জন প্রার্থীর নিয়োগ পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণে এতোদিন আটকে থাকলেও অবশেষে তারা যোগদান করেছে। উত্তীর্ণ হয়েও চাকরিতে যোগ করতে না পারায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত এসব চাকরি প্রত্যাশীরা। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ ভেরিফিকেশন চলমান অবস্থায় তাদের পছন্দের স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় যোগদান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে ১২টি বিষয়ে মোট ২ হাজার ৬৫ জন শিক্ষককে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে যোগদান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে চাকুরি প্রত্যাশীদের হতাশা কেটে মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে।

করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। চাকুরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা শুরু হলেও বর্তমানে অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চাকুরি প্রার্থীরা। একদিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বন্ধ অন্যদিকে পরীক্ষা স্থগিত হলেও থেমে নেই বয়স। যাদের মাস্টার্স শেষ করে চাকুরি করার কথা তাদের অনেকের আবার অনার্সই শেষ হয়নি বৈশ্বিক মহামারির কারণে। অনেকেই দীর্ঘ ব্যস্ততা ও চেষ্টার পরও একটা চাকুরি পেতে জীবন যুদ্ধে পরাজিত। পরাজিত হয়ে জীবনের উপর আক্ষেপ করে কেউ আবার আত্মহত্যার মতো জঘন্য ও ঘৃণিত পথ বেছে নিচ্ছে। আসলে এ সমাজে এটার প্রচলন একদিনেই হয়নি। বরং উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে লেখা-পড়া শেষ করে চাকুরি প্রত্যাশীরা যখন একটা ছোট্ট চাকুরি যোগাড় করতে পারে না তখন লজ্জায় অভিভাবকের সামনে মুখ দেখাতে পারে না। আর এর মাধ্যমেই আস্তে আস্তে তারা বেঁচে থাকার আগ্রহ হারায়।

চাকুরি প্রত্যাশীদের অনেকেই বিভিন্ন চাকুরিতে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত। কিন্তু করোনা ভাইরাস এবং কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। যেমন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সস্টিটিউট বা পিটিআই এ ৯ম গ্রেডের ইন্সট্রাক্টর (বিজ্ঞান, কৃষি, শারীরিক শিক্ষা এবং চারু ও কারুকলা) পদে মোট ৯৮ জনকে বিপিএসসি ২৮ অক্টোবর, ২০২০ চূড়ান্ত সুপারিশ করে। চূড়ান্ত সুপারিশের দীর্ঘ ১৪ মাস হলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও গেজেট প্রকাশ করতে পারছে না। অনেক পরিশ্রম করে বেকার যুবকরা যখন তাদের বিশ্বসের আশ্রয়স্থল পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে চাকুরিতে যোগদানের অপেক্ষায় প্রহর গুনে আর স্বপ্ন দেখে তখন সত্যি ভালো লাগে। কিন্তু এ অপেক্ষা যখন মাসের পর মাস পেরিয়ে বছর পেরিয়ে যায় তখন অপমান আর লজ্জা তাদের যেন আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করে। এ অবস্থায় যদি আক্ষেপ ও হতাশা নিয়ে তাদের কেউ আত্মহত্যা করে তখন দায়ভার নেয়ার কেউ থাকবে? 

২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা পিটিআইসমূহে বিভিন্ন বিষয়ের  ইন্সট্রাক্টর পদ শূণ্য থাকায় ৯ম গ্রেডের ৭২টি বিষয়ভিত্তিক ইন্সট্রাক্টর এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভার মাধ্যমে বিপিএসসি ২৮ অক্টোবর, ২০২০ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯৮ জনকে চূড়ান্ত সুপারিশ করে। সামান্য ৯৮ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যদি ৩ বছর লাগে তবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কীভাবে দেখবো? অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সদিচ্ছার মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) এ ৭৭টি পদের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়ে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও মৌখিক পরীক্ষা আটকে আছে। দীর্ঘদিন পর কখনও যদি কোন ইন্সট্রাক্টর এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় তাও আবার বিভিন্ন মামলা জটিলতায় স্থগিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা একদিন ধ্বংস হবে। 

আজ চাকুরি প্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করলে আমাদের মাথা ব্যথা শুরু হয়। কিন্তু একজন শিক্ষিত হয়েও কেন আত্মহত্যা করছে তার প্রকৃত কারণ আমরা খুঁজতে ব্যর্থ। পিতা-মাতা যখন তাদের একমাত্র অবলম্বন আদরের ছেলে-মেয়েকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে পড়ালেখা করিয়ে বেকারত্ব দেখে কষ্ট পান তখন তাঁদের সন্তান কীভাবে সমাজে মুখ দেখাবে? দীর্ঘ সাধনার পর যখন শুনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল, পরীক্ষা স্থগিত, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি তখন একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের আত্মহত্যা ছাড়া কোন পথ থাকে কি? এমতাবস্থায় শিক্ষা আর ভারি ভারি সনদ ও ডিগ্রী কোন কাজে লাগে না।

পিটিআই ইন্সট্রাক্টর সুপারিশপ্রাপ্তদের প্রায় সবাই বেকার। ইন্সট্রাক্টর পদে যোগদানের আশায় তাদের বেশিরভাগই নতুন করে কোথাও চাকুরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না। আবার কেউ কেউ ছোট চাকুরিতে যোগদানও করেনি। অনেকেই আর চাকুরি প্রস্তুতি নিচ্ছে না। ফলে তাদের একমাত্র এবং শেষ ভরসা পিটিআই। কিন্তু বছর পার হলেও যখন প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না তখন ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনা আটকে যাচ্ছে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং সমাজের অনেকেই তাদের সুপারিশপ্রাপ্তের কথা বিশ্বাস করছে না। তাই লজ্জায় অনেকে বাহির হতে পারছে না। সন্তান হিসেবে পরিবারের একমাত্র ভরসা হিসেবে থাকলেও যোগদান করতে না পারায় বাবা-মায়ের কথা রাখতে পারছে না। বৃদ্ধ পিতা-মাতার শেষ ভরসা যখন সুপারিশ পেয়েও যোগদান করতে পারে না তখন অভিভাবকের অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে শোকে মরার উপক্রম। এমতাবস্থায় যদি দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা না যায় তবে তারা চাকুরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এমনকি নিজের উপর আক্ষেপ নিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিতে পারে। তাই অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত ইন্সট্রাক্টরগণের পদায়নের মাধ্যমে যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

লেখক: শাহাদাত আনসারী, সুপারিশপ্রাপ্ত পিটিআই ইন্সট্রাক্টর।

এসএ/