আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, আমলাতন্ত্রের গোলাম নই
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
দেশের বিভিন্ন জেলায় বাস্তবায়নরত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত (এডিপি) প্রকল্পগুলোর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রদান করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সারা দেশে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকৌশলীরা। প্রকৌশলীদের সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশন, বাংলাদেশ (আইইবি) বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আইইবি কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদী মানববন্ধনের আয়োজন করে।
মানববন্ধনের সভাপতিত্ব করেন আইইবি'র সার্ভিসেস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান এস এম মনজুরুল হক মঞ্জু।
তিনি বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া অযৌক্তিক ও উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।
এই মানববন্ধনের আয়োজনকে 'আমলাতন্ত্রের জ্বালাতনের প্রতিবাদে প্রাথমিক বার্তা' হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সারা দেশে আজ প্রকৌশলীরা একজোট হয়েছেন। ডাক্তার ও কৃষিবিদরাও আমাদের আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্তের চিঠি প্রত্যাহার করা না হলে পেশাজীবীদের মর্যাদার প্রয়োজনে কর্মবিরতিসহ কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, আমলাতন্ত্রের গোলাম নই। সারা দেশে ইঞ্জিনিয়াররা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম বাস্তবায়নকারী তারাই। তাদের কাজের মূল্যায়ন ও পরীবিক্ষণ করতে হলে যে ধরনের কারিগরি যোগ্যতার প্রয়োজন, সেটি ডিসি-এডিসিদের নেই। আমরা বিসিএসের একটিমাত্র ক্যাডারের অনুগত নই। আপনারা ডিসি-এডিসিরা প্রকল্প মূল্যায়নের নামে সিনিয়র প্রকৌশলীদের ডেকে নিয়ে যাবেন, অপমান করবেন, সেটা হতে দেওয়া হবে না। তা-ও যদি আপনাদের কারিগরি বিষয়ে জ্ঞান থাকতো, তাহলে মেনে নিতাম। আপনারা বিসিএস করেছেন, আমরাও ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিলাম,' তিনি মন্তব্য করেন।
আইইবি'র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলীরা সারা দেশে কাজ করে থাকেন। তাদের কাজের কাজ মূল্যায়ন-পরীবিক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের কাছে তারা জবাবদিহিতা করেন।আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আপনাদের কাজ আপনারা করেন। আপনাদের কাজের মধ্যে একটা হচ্ছে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ। সেটা করতে না পারার কারণে বহু প্রকল্পের কাজ আটকে যায়। বাস্তবায়নে ধীরগতি হয়।' সম্প্রতি ডিসি সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে এ ধরনের দাবি করা হলে প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তারপরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কীভাবে রাতের অন্ধকারে এ ধরনের একটি চিঠি দিয়ে 'অযৌক্তিক' একটি সিদ্ধান্তের কথা জানাতে পারে?
উল্লেখ্য, গত ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসককে এডিপিভুক্ত শতভাগ প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব প্রদান করে একটি পত্র জারি করে। আদেশটি জারির পর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। একই সঙ্গে আদেশটিকে দেশের উন্নয়নবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করে তারা। এরই মধ্যে গত ৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার আইইবি’র অ্যাসোসিয়েশনের সার্ভিসেস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির ২৫৪তম বর্ধিত সভায় নেতারা কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেন। সভায় জনপ্রশাসনের আদেশটি বাতিল করা, সব সংস্থার প্রকৌশলীকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি জেলা প্রশাসককে না প্রদান করার আদেশ, আদেশটি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত প্রকৌশল দপ্তরে প্রত্যাহার-সংক্রান্ত ব্যানার প্রদর্শন ও মন্ত্রণালয়, মন্ত্রীকে আদেশটির প্রতিবাদে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে জনপ্রশাসনের ওই চিঠি বাতিলের যুক্তিসম্বলিত একটি চিঠি আজই পরিকল্পনামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে দেওয়া হবে বলে আইইবি সূত্রে জানা গেছে। ‘ডিসিগণকে শতভাগ প্রকল্পের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব প্রদান সম্পর্কিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাতিল প্রসঙ্গে’ শিরোনামে অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহাদৎ হোসেন (শীবলু) স্বাক্ষরিত পরিকল্পনামন্ত্রী বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির আলোকে প্রকৌশলীদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায় পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো স্থাপনা বাস্তবায়ন বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গত ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০২২ইং তারিখে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে ডিসিগণ কর্তৃক প্রকল্পের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা সম্পর্কিত একটি অযৌক্তিক দাবি উত্থাপন করার প্রেক্ষিতে আপনি তাৎক্ষণিক নাকচ করে দেন। তারপরও জনপ্রশসন মন্ত্রণালয়ের গত ১৮ জানুয়ারি ২০২২ইং স্মরক নং- ০৫.০০.০০০০.১৪১.৯৯.০০১.২১.০৩ মূলে জারিকৃত পত্রের মাধ্যমে ডিসিগণকে এডিপিভুক্ত শতভাগ প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব প্রদান সম্পর্কিত আফিস স্মরক করা হয়েছে, যা আপনার আদেশ অমান্য করার সামিল। উক্ত আদেশকে দেশের উন্নয়নবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে আইইবি মনে করে।’ চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘এমতাবস্থায়, প্রতিবন্ধক উল্লেখিত আদেশ অনতিবিলম্বে বাতিল করার জন্য আপনার নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় দেশের লক্ষাধিক প্রকৌশলীর আশ্রয়স্থল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) প্রকৌশলীদের সাথে নিয়ে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করতেম বাধ্য হবে।’
এই প্রসঙ্গে আইইবি সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহাদৎ হোসেন (শীবলু) গণমাধ্যমে বলেন, ‘এই আদেশের ফলে উন্নয়ন কার্যক্রমের গতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা এই আদেশ বাতিলের দাবিতে বৃহস্পতিবার (আজ) রাজধানী ঢাকাসহ আমাদের প্রতিটি শাখায় মানববন্ধন করব। একই সাথে কয়েকজন মন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হবে। যদি এসব পদক্ষেপের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেই চিঠি প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে আগামীতে কালো ব্যাচ ধারণসহ কর্মবিরতির মতো কঠোর আন্দোলনের দিকে যাব। এই আদেশে প্রকৌশলীদের মর্যাদা ক্ষুণœ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।’
গত ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এডিপিভুক্ত শতভাগ প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে সব জেলার ডিসিদের কাছে এই চিঠি পাঠায়; যার অনুলিপি কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত, ওই দিনই জেলা প্রশাসক সম্মেলন শুরু হয়। যেখানে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরিবীক্ষণ কার্যক্রমে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নেতৃত্বে একটি মনিটরিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব তোলা হয়। তবে এ প্রস্তাবে সম্মতি দেননি পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। জেলা পর্যায়ের সব নির্বাহী প্রকৌশলী পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা। অন্যদিকে জেলা প্রশাসকরাও পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা। ফলে ডিসিদের প্রকল্প তদারকির সুযোগ দিতে চান না প্রকৌশলীরা।
আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যত কমানো যায়, দেশের উন্নয়ন তত ত্বরান্বিত হয়। আর আমরা ইজ্ঞিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা মনে করি, প্রশাসনে যার যে দায়িত্ব ও যার যে কাজ, সে সেটা করবে। বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রকৌশলীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিদ্যুৎ সেক্টর, যোগাযোগ সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজের পরিবেশ করে দিয়েছে বলেই আজকে দেশে এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। সারাদেশে এমন কোনো জায়গা নেই যে প্রকৌশলীদের ছোঁয়া নেই। সেখানে যদি এমন কিছু করা হয়, তাহলে কাজের গতি মন্থর হবে। অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্তের কারণে কাজে ভুল হবে ও কাজের গতি কমে যাবে। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমি মনে করি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যে বিবৃতি দিয়েছে, যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা সঠিক করেছে। বিষয়গুলো সরকারকে জানানোও পেশাজীবী সংগঠনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলেও মনে করেন আইইবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুস সবুর।
এই বিষয়ে কথা বলার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একাধিক বার যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এসএ/