পিলখানা ট্রাজেডি: মামলার নিষ্পত্তি হয়নি আজও


Janobani

আজাহারুল ইসলাম সুজন

প্রকাশ: ০৭:২০ পূর্বাহ্ন, ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩


পিলখানা ট্রাজেডি: মামলার নিষ্পত্তি হয়নি আজও
ফাইল ছবি

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রচণ্ড গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে পিলখানার তৎকালীন বিডিআর বর্তমান বিজিবি সদর দফতর ও আশপাশের আবাসিক এলাকা। পিলখানা ছাপিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাসহ সারা দেশে। আশপাশের মানুষের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন ছিল দেয়ালঘেরা বিডিআর সদর দপ্তরে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন ভেতরে তখন কী ভয়াবহ এক বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে চলেছে। বিদ্রোহের নামে প্রথমেই তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে হত্যা করা হয়। সেদিন দেশের বীর সন্তানদের লাশ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম দিনের ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ।


২৪ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল রাইফেলস সপ্তাহের তিন দিনের বর্ণিল আয়োজন। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালেই ভারী অস্ত্র, বুলেটের গর্জন আর বিডিয়ার জওয়ানদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সেই আয়োজনকে করে দেয় ধূলিস্বত। দেশজুড়ে তৈরি হয় শোকের আবহ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় এমন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ষড়যন্ত্রকারীরা।


২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় পিলখানায় সারা দেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ ২ হাজার ৫৬০ জন সদস্যে নিয়ে বার্ষিক দরবার শুরু হয় ।  তখন পরিপূর্ণ দরবার হল, দরবার মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। কিছু সময়ের মধ্যেই প্রচণ্ড গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে পিলখানার তৎকালীন বিডিআর বর্তমান বিজিবি সদর দফতরের দরবার হলসহ আশপাশের এলাকা। বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে হত্যা করা হয়। এরপর বিভীষিকাময় দুদিনে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, নারী-শিশুসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।


২০১০ সালের ১২ জুলাই পিলখানা হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে সম্পূরক চার্জশিটে আরও ২৬ জনকে আসামি করা হয়। 


২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এ নির্মম হত্যা মামলার রায় দেন। রায়ে ৮৫০ জন আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৭১ জনকে খালাস  দেওয়া হয়। দুই থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২৬৬ জনকে।


২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ আসামি।


রায় ঘোষণার দুই বছরের বেশি সময় পর গত বছরের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। দেশের ইতিহাসে এই মামলার আসামির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যার দিক থেকেও এটি সবচেয়ে বড় রায়। তবে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের করা আপিল শুনানি শুরু না হওয়ায় হত্যা মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি আজও।


মামলার অভিযোগপত্র ও  সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার কিছু আগে জওয়ানদের একটি দল অস্ত্রাগারে গিয়ে সেখানে দায়িত্বরত এক মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। দরবারে বিডিআর মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের বক্তব্য চলাকালে সিপাহি কাজল ও মইন অস্ত্র হাতে অতর্কিতে মঞ্চে উঠে অস্ত্র তাক করেন। এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে নিরস্ত্র করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের একটি অংশ দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদের নানা দাবি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। মহাপরিচালক শাকিল সবাইকে বারবার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন। তখনই সিপাহিদের মধ্য থেকে ‘জাগো’ স্লোগান আসে।


এরপরই সশস্ত্র অবস্থায় সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল দরবার হলে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।দরবার হলের বাইরেও শোনা যায় গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যে বিদ্রোহী জওয়ানরা লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধে দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন।


বিদ্রোহীরা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দরবার হল থেকে কর্মকর্তাদের সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। দরবার হলের বাইরে পা রাখামাত্র মহাপরিচালককে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন চার সেনা। এরপরই হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে। দরবার হলের বাইরে প্রথমেই হত্যা করা হয় তখনকার ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হককে। শুরু হয় পিলখানাজুড়ে তাণ্ডব। চলে সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারকে হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।


মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ষড়যন্ত্রকারীরা দরবার অনুষ্ঠানের আয়োজনকে সামনে রেখেই নিয়েছিল বিদ্রোহের প্রস্তুতি। সে ষড়যন্ত্র গোয়েন্দারাও আঁচ করতে পারেনি। বিডিআর সদস্যরা জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, রেশন-বৈষম্য, ডাল-ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিদ্রোহের বেশ কয়েক দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসসহ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলার চেষ্টা করেন। এসব দাবি নিয়ে বিডিআরের কিছু সদস্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আসছিলেন। পাশাপাশি অন্যদেরও দলে ভেড়ানোর চেষ্টা ছিল তাদের।


২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সপ্তাহ শুরুর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় আসেন। ইতিমধ্যে প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের দাবিদাওয়ার কিছু না হওয়ায় সুবেদার গোফরান মল্লিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন কয়েকজন জওয়ান। এর আগেই তারা দাবিদাওয়া নিয়ে বিডিআর ৫ নম্বর ফটকের কাছে এক কোচিং সেন্টারে প্রচারপত্র বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তা বিতরণ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সঙ্গে তার বাসার কাছে কয়েকজন বিডিআর সদস্য কথা বলেন এবং পিন্টু তাদের ৫ নম্বর ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দেন।


২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় দরবার শুরু হওয়ার আগে সিপাহি মইন উদ্দিন ও সেলিম রেজার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা জড়ো হন। শুরু হয় বিদ্রোহ।


বিদ্রোহ এবং সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা, নির্যাতন, জিম্মির খবর পেয়ে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে পিলখানার দিকে রওনা হন সেনাসদস্যরা। বেলা ১১টার মধ্যেই তারা ধানমন্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। বিদ্রোহীরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।


দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। তারা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।


দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদাপতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিডিআর প্রতিনিধিদলের দেখা করার ব্যবস্থা করেন।


এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন পিলখানায় কর্মরত ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি নাসির উদ্দিন খান, ডিএডি মির্জা হাবিবুর রহমান, ডিএডি আবদুর রহিম, ডিএডি জলিল, সিপাহি সেলিম রেজাসহ কয়েকজন।


ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।


সন্ধ্যা ৬টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। তারা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।


২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পিলখানায় বিডিআরের সংখ্যা কমতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পোশাক পালটে পিলখানার বিভিন্ন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন বিডিআর জওয়ানরা।


একপর্যায়ে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা আবার অস্ত্র সমর্পণের কথা বলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তারা অস্ত্র এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি বুঝিয়ে দেন। পরে পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।


২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। সে বিদ্রোহে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। পিলখানা থেকে উদ্ধার হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র।