৮ দিন পায়ে হেঁটে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বীর প্রতীক আব্দুল হাই


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৯:৫১ অপরাহ্ন, ১৫ই মার্চ ২০২৩


৮ দিন পায়ে হেঁটে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বীর প্রতীক আব্দুল হাই
আব্দুল হাই

আব্দুল হাই সরকার একাত্তরে ১৬ বছরের টগবগে তরুণ তিনি। ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেছেন। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা শুরু হলে দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে অংশ নিতে ৮ দিন হেঁটে ঢাকা থেকে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসার মালভাঙায় ফেরেন তিনি। বাবা-মার অনুমতি নিয়ে মাতৃভূমি রক্ষায় সম্মুখযুদ্ধে নামেন। দীর্ঘ লড়াই শেষে স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করেই ঘরে ফেরেন।


মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এই কিশোর প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল হাই সরকার। দেশকে হানাদারমুক্ত করার এই লড়াইয়ে অসীম সাহসিকতার জন্য পেয়েছেন চতুর্থ সর্বোচ্চ উপাধি বীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধীন কুড়িগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ করেন তিনি। ওই সময় গড়ে তোলেন হাই কোম্পানি, যার অধিনায়ক ছিলেন এ গেরিলা যোদ্ধা। সাংবাদিকদের সাথে  একান্ত আলাপচারিতায় কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাই সরকার বীর প্রতীক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।


১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় শত্রুদের গতিবিধির খবর দিতেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে। 


যুদ্ধে যাওয়ার গল্প জানতে চাইলে গড়গড় করে বলতে থাকেন তিনি। বলেন, ১৯৭১-এ ঢাকায় (পিটিসি) পাকিস্তান টোব্যাকো কোম্পানির (বর্তমানে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানি) চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ছিলাম। শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ভূইয়ার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভায় যাই আমরা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রথম মনে হয়েছিল দেশটা স্বাধীন হওয়া দরকার। দ্বিতীয় ভাবনা ছিল মুক্তিযুদ্ধ করব। এরপর ২৫ মার্চের কালরাতসহ ঢাকায় অনেক ঘটনা তখন।


রাজধানীতে কারফিউ শিথিল হলে ১ এপ্রিল সকালে হেঁটে রওনা হই। কলেরা হাসপাতাল হয়ে গুলশান দিয়ে ঘোড়াশাল, কাপাসিয়া হয়ে ময়মনসিংহ দিয়ে বাড়িতে পৌঁছাই ৮ এপ্রিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আট দিন হেঁটেছি। ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসেছি। বাড়িতে এসে সপ্তাহখানেক থেকে যুদ্ধে যাই। 


তিনি বলেন, আমি ১৫ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাটে আমাদের আনা হয়। সোনাহাট রেলওয়ে সেতুতে অপারেশনে ছিলাম। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের কয়েকজনকে ক্যাম্পে ফের নেওয়া হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে ১৫ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে আসি গিদালদাহ। সেখান থেকে লালমনিরহাটে একটি অপারেশন করি আমরা। 


কুলাঘাট হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ফুলবাড়ীতে ঢোকার চেষ্টা করছিল। আমরা খবর পেয়ে অপারেশনে যাই। সেদিন তাদের প্রতিরোধ করি। ১৪ আগস্ট নাগেশ্বরীর গাগলায় শত্রুদের পরাজিত করি। নাগেশ্বরীর নাখারগঞ্জে ফেরার পথে হানাদার বাহিনীর থ্রিইন্স মর্টার সেলে আহত হলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাঘডোরা সেনাক্যাম্পে।


ক্যাম্পে ১৫ দিন চিকিৎসা শেষে বিশ্রামে ছিলাম। এ অবস্থায় নির্দেশ পেলাম কুড়িগ্রামে অপারেশনে যাওয়ার। একদিন এক রাজাকারকে অস্ত্রসহ ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাই। ততদিনে আমাকে প্লাটুন কমান্ডারে উন্নীত করা হয়েছে। প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসায় রাজাকার ও পাকবাহিনীর ক্যাম্পের সামনে সম্মুখযুদ্ধ করি। সে যুদ্ধে পিছু হঠতে বাধ্য হয় তারা। তখন মোগলবাসায় আমরা একটি ক্যাম্প করি।


বীরপ্রতীক আব্দুল হাই বলেন, আমার প্লাটুনে ৩৩৫ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত রণাঙ্গনে ছিলাম।


একটা বিশেষ অপারেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, নভেম্বরের শেষের দিকে আমার কাছে খবর আসে পাকিস্তানিরা রসদভর্তি ট্রেনে কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুরে যাবে। ২৬ নভেম্বর ভোরে অ্যান্টিট্যাংক মাইন পেতে তাদের ট্রেনটি ধ্বংস করি। সেখানে বেঁচে যাওয়াদের সঙ্গেও যুদ্ধ হয় আমাদের। ৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম শহরে এলে তাদের ঘিরে ফেলি। ওইদিন ২০ জনেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।


আরেকদিন আমরা ও পাকিস্তানি সেনারা খুব কাছাকাছি অবস্থান করে যুদ্ধ করি। এরপর ৬ ডিসেম্বর বিমানবাহিনী কুড়িগ্রামের আকাশে টহল দিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পগুলোতে ফায়ারিং করলে ভীত হয়ে পালিয়ে যায় তারা। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় শহরে পতাকা ওড়ানো হয়।


আমার কাছে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত ছয়টি পতাকা ছিল। প্রথমে আমাদের ক্যাম্পগুলোতে পতাকা উত্তোলন করা হয়। আমরা রাইফেল, এসলার, এসএমজি নিয়ে উল্লাস করি। সেপ্টেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুড়িগ্রামে আমার কোম্পানি ছিল। আর একটি কোম্পানি ছিল নাজিম খাঁ এলাকায়। 


স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি জাতির মুক্তির আশায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই আমার প্রধান চাওয়া। 


কথা শেষে একটু ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ৫০ বছরেও আমি আওয়ামী লীগের কোনো সুবিধা নিইনি। আমি বীর নিবাস পাইনি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকায় বাড়ি পাওয়ার কথা, সেটাও পাইনি। তবে যুদ্ধাহত হিসেবে রেশন পাচ্ছি, যুদ্ধাহত ভাতা পাচ্ছি।