১৯৭১-এ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবরের পরিসংখ্যান
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:০৬ পূর্বাহ্ন, ২৮শে মার্চ ২০২৩
১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবরের পরিসংখ্যান (অপূর্ণাঙ্গ) বেরিয়ে এসেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গবেষক কবি জয়দুল হোসেন ও প্রকাশিত বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৯টি উপজেলায় মোট গণহত্যার সংখ্যা ৩৪৩টি, বধ্যভূমি ৫০টি, গণকবর ১৮০টি, নির্যাতন কেন্দ্র ৯২টি।
এর মাঝে সদর উপজেলায় গণহত্যা ৭৮, বধ্যভূমি ০৯, গণকবর ২০, নির্যাতন কেন্দ্র ১৭, মোট ১২৪টি, আশুগঞ্জ উপজেলায় গণহত্যা ৩৮, বধ্যভূমি ০৭, গণকবর ১৫, নির্যাতন কেন্দ্র ০৫, মোট ৬৫টি, সরাইল উপজেলায় গণহত্যা ২৯, বধ্যভূমি ০৫, গণকবর ২৭, নির্যাতন কেন্দ্র ০৫, মোট ৬৬টি, নাসিরনগর উপজেলায় গণহত্যা ৩৯, বধ্যভূমি ০১, গণকবর ১৬, নির্যাতন কেন্দ্র ০৫, মোট ৬১টি, আখাউড়া উপজেলায় গণহত্যা ২৩, বধ্যভূমি ০৭, গণকবর ১৬, নির্যাতন কেন্দ্র ১০, মোট ৫৬টি, কসবা উপজেলায় গণহত্যা ৫৬, বধ্যভূমি ০৬, গণকবর ৬৪, নির্যাতন কেন্দ্র ১৫, মোট ১৪১টি, নবীনগর উপজেলায় গণহত্যা ৩৯, বধ্যভূমি ০৪, গণকবরের তথ্য পাওয়া যায়নি, নির্যাতন কেন্দ্র ০৫ মোট ৪৮টি, বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় গণহত্যা ২২, বধ্যভূমি ০৮, গণকবর ০৯, নির্যাতন কেন্দ্র ১৫, মোট ৫৪টি এবং বিজয়নগর উপজেলায় গণহত্যা ১৯, বধ্যভূমির ০৩, গণকবর ১৩, নির্যাতন কেন্দ্র ১৫, মোট ৫০টি তথ্য পাওয়া যায়। এখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকটি গ্রামের গণহত্যা একত্রে এক নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেগুলো আলাদা করলে গণহত্যার সংখ্যা আরো অধিক হবে। গণহত্যার শিকার অনেক শহিদের লাশ পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। তিতাস ও মেঘনা নদীর তীরের গণকবরগুলো এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বধ্যভূমি ও গণকবর অনেক ক্ষেত্রে একই স্থানে অবস্থিত। এসব ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও এক এবং কোথাও কোথাও একাধিক গণহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আশুগঞ্জ মেঘনা নদীর তীরে শতাধিক, সরাইলের শাহবাজপুর তিতাস নদীর তীরে এবং কালীকচ্ছ ধর্মতীর্থ বিলের পাশে শতাধিক, কসবার চন্ডীদ্বার ও হারিয়াবহ গ্রামে অর্ধ শতাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যরা এই গণহত্যা ও নির্যাতনে সহযোগিতা করেছে। এর শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে। বিভিন্ন সেনানিবাস, পুলিশ লাইন ও ইপিআর ক্যাম্পগুলোতে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রাবাসে হামলা চালিয়ে নিরীহ ছাত্রদের হত্যা করা হয়। আবাসিক এলাকায় চালানো হয় গণহত্যা। পর্যায়ক্রমে এই নির্মম গণহত্যা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াও এর বাইরে ছিল না। তবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও ছাত্র-জনতা মিলিতভাবে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর এলাকাকে হানাদারমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
এর আগে ১৪ এপ্রিল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আশুগঞ্জে ব্যাপক গণহত্যা শুরু হয়ে যায়। ১৭ এপ্রিলের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এলাকা দখলের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। এরপর এপ্রিল মাসের মধ্যেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় সকল এলাকা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে চলে যায়। শুরু হয় নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতন। বিভিন্ন এলাকায় গঠন করা হয় শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। এসব বাহিনী গণহত্যা, নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে।
তাদের সহযোগিতায় তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার প্রায় সর্বত্র নির্যাতন ও গণহত্যার তাÐব চালানো হয়েছে। নয় মাসে কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখন আর সংগ্রহ করা সম্ভব না হলেও প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বিবরণ অনুযায়ী গণহত্যার যে তীব্রতা জানা যায় তার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজারের অধিক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চল। কসবা আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার প্রায় ৭৩ কিলোমিটার এলাকা ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার শরণার্থীরা এদিক দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত এবং শহিদ হয়েছেন স্থানীয় জনগণও। সীমান্ত অঞ্চল বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় অধিক পরিমাণে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
যুদ্ধের আগে এবং পরে এলাকাবাসীও গণহত্যার শিকার হয়েছেন। দৈনিক জনবাণী’র প্রতিনিধিকে বিষয়গুলো বলছিলেন গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবরের জরিপকারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গবেষক সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন। তিনি বলেন, জরিপ কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলায় ৬৪৯টি গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বাইরেও বেশ কিছু গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতন কেন্দ্র এবং শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কবর অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।