কাঁচা চা পাতার দাম নেই, হতাশ পঞ্চগড়ে চা চাষিরা
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬:৪১ অপরাহ্ন, ২৪শে মে ২০২৩
পঞ্চগড়ের কাঁচা চা পাতার দাম না পেয়ে অনেক চা চাষি বাগান কেটে ফেলছে। আগের মতো আবারো কাঁচা পাতা নিয়ে বিপাকে পড়ছে চা চাষিরা। তারা চা বাগান রাখবে না কেটে ফেলবে তা নিয়ে বেশ চিন্তিত।
পঞ্চগড়ের বিস্তৃর্ণ এলাকায় চা চাষে সবুজ হয়ে ওঠলেও এখন তা গলার কাটা হয়ে গেছে। এ জেলায় মোট চা চাষি ৭ হাজার ৩৩৮ জন। তার মধ্যে প্রান্তিক চাষি ৭ হাজার ৩১০ জন।
২০০০ সালে প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের সমতলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের গোড়াপত্তন হয়। দুই দশকেই চা চাষের বিপ্লব ঘটে জেলাটিতে। চা উৎপাদনে এরই মধ্যে দ্বিতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়। প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে ছোট বড় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার চা বাগান। বর্তমানে জেলায় ২৩ টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকার চাষি হাবিবুর রহমান বলেন, নিজের জমিতে ২০১৬ সাল থেকে ৬ বিঘা জমিতে চা চাষ করে আসছেন।
তিনি বলেন, বর্তমান চায়ের অবস্থা নাজুক। এই ৩২/৩৩ ডিগ্রী তাপমাত্রার পরেও কারখানার মালিকরা পাতা কাটার পর কারো কাছে ৩০% কারো ৫০% কর্তন করে চায়ের দাম দিচ্ছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের যুগে আসলে সার কীটনাশক দিয়েসহ সব কিছু দিয়ে চা চাষিরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এটা কারখানার মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করছে।
হাবিবুর বলেন, আমি এর মধ্যে ৩০ শতক জমির চা গাছ কেটে ফেলেছি।একই উপজেলার শারিয়াতজোত এলাকার তরুণ সাঈদ আলী। নিজের বেকারত্ব দূর করতে ৪ বছর আগে ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশের এক একর জমিতে চা বাগান করেছিলেন তিনি। হতাশা আর ক্ষোভে নিজের স্বপ্নের চায়ের বাগানের এক একটি গাছ এখন উপড়ে ফেলছেন।
সাঈদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে চা বাগান করে ক্রমাগত লোকসান হচ্ছে আমার। ঋণ করে চা বাগান করেছি। কিন্তু ন্যায্যমূল পাচ্ছি না। প্রতি বছর চায়ের ভরা মৌসুম এলেই কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেট করে চা পাতার দাম কমিয়ে দেয়। তাদের সিন্ডিকেট কেউ ভাঙতে পারছে না। প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার দর ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কারখানা মালিক খেয়াল খুশি মতো ১৩ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে কিনছেন। তার মধ্য থেকে ওজন থেকে আবার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে আমাদের দাম দিচ্ছেন। আমরা পাচ্ছি কেজি প্রতি মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকা। এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের মজুরিই পরিশোধ করতে পারছি না। কারখানা মালিকরা আমাদের টাকায় বছরে বছরে কারখানার পরিধি বাড়াচ্ছে। আর আমরা ঠকেই চলেছি। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।
তার মতো একই এলাকার রফিকুল ইসলাম চা পাতা বিক্রি করতে গিয়ে কারখানা মালিকদের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে দুই বিঘা জমির চা বাগান উপড়ে ফেলে বেগুণসহ শাক সবজি চাষ শুরু করেছেন।
শুধু সাঈদ ও রফিকুল নয় তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক ক্ষুদ্র চা চাষিরা ক্রমাগত লোকসানে পড়ে চা বাগান ভেঙে ফেলছেন। কয়েক বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ তিন গুণ বাড়লেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা।
চাষিদের অভিযোগ ভরা মৌসুমে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট, কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, অবৈধভাবে কালো বাজারে চা বিক্রি, নিলাম বাজারে নিম্নমানের চা সরবরাহ, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দুর্বল মনিটরিংসহ বিভিন্ন কারণে পঞ্চগড়ের ব্যাপক সম্ভাবনাময়ী সমতলের চা শিল্প বর্তমানে হুমকিতে পড়েছেন জানান চাষিরা।
চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে কারখানা কম থাকলেও প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩৮ টাকা কেজি পর্যন্ত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চলছে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট। চায়ের দাম ১৮ টাকার উপরে উঠতে পারেনি। সর্বশেষ জেলা কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজির সর্বনিম্ন দর নির্ধারণ করে ১৮ টাকা।
তেঁতুলিয়ার চা চাষি ইউসুফ আলী বলেন, আমরা কষ্ট করে চা আবাদ করি আর কারখানা মালিকা বিনাশ্রমে অর্ধেক চা নিয়ে নেয়। তারা আমাদের মানুষ মনে করে না। বর্তমানে চা পাতা বিক্রি করে যে টাকা পাচ্ছি তা দিয়ে কামলা খরচ আর পথ খরচই উঠে না। এদিকে ঋণের কিস্তির জন্য এনজিও লোক বাড়িতে বসে থাকে। কিস্তির টাকা দিতে পারিনা। সার কীটনাশকের দোকানে বাকি সেই টাকাও পরিশোধ করতে পারছি না। তাই বাগানই কেটে ফেলেছি।
চা চাষি কাজী মোকছেদ বলেন, বাজারে তৈরি চায়ের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। অথচ কাঁচা চায়ের দাম প্রতিনিয়ত কমছে। মূলত সমতলের চা শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য কারখানা মালিকরা এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। প্রশাসন ভূমিকাও রহস্যজনক। তারা ব্যবস্থা নিতে নিতে দেখা যাবে মৌসুম শেষ হয়ে গেছে।
কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও চা চাষি আব্দুল লতিফ তারিন বলেন, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ চা চাষের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে পড়ে লোকসান হওয়ায় তারা বাগান ভেঙে ফেলছেন। কারখানা মালিকরা দাম কমার পেছনে বড় পাতাকে দায়ী কারছেন। কিন্তু তারা কম দাম ও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন থেকে বাদ দিয়ে ঠিকই বড় পাতা নিয়েই চা বানাচ্ছেন। এছাড়া তারা ভালো মানের চা কাস্টমসের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে প্রতিদিন কালোবাজারে বিক্রি করছেন। আর নিম্নমানের চা নিলাম বাজারে সরবরাহ করে কম দাম পাওয়ার অভিযোগ তুলছেন। পঞ্চগড়ের চা শিল্প বাঁচাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খরার কারণে চা মৌসুমের শুরুতে তেমন পাতা পাওয়া যায়নি। এখন সব চাষির পাতা একসাথে উঠছে। ধারণ ক্ষমতা না থাকলেও মানুষের আকুতি মিনতিতে আমাদের ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ চা বর্তমানে কিনতে হচ্ছে। ছোট পাতা সরবরাহ করলে ১৮ টাকা দরেই কেনা হচ্ছে। তবে বর্তমানে চা চাষি ও কারখানা মালিকদের মাঝে একটি দালালচক্র ঢুকেছে। কারখানাগুলো ১০ শতাংশ কর্তন করলে তারা ২০% কর্তন করে। তবে বাগান মালিকদের মধ্যে যেমন কিছু অসাধু মানুষ রয়েছেন তেমনি কিছু অসাধু কারখানা মালিকও রয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। এছাড়া সমসাময়িক নানা কারণে পঞ্চগড়ের কারখানা মালিকদের সংগঠনের সভাপতির পদ থেকেও অব্যাহতির জন্য আবেদন জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন বলেন, কারখানা মালিকরা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো দরে চা পাতা কিনছেন। তারা চাষিদের সাথে অমানবিক আচরণ করছেন। আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক, চা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছি।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার কম দাম ও কর্তন করে দাম দেয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। শিগগিরই চা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
জেবি/ আরএইচ/