জাপান বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ও আস্থার
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
বৈচিত্র্যে ভরপুর সূর্য উদয়ের দেশে 'মমিজি মাতসুরি' বা রঙিন পাতা দেখার উৎসবের দিন, গাছের পাতার রঙ বদলে গাঢ় লাল বা হলুদ যেন রঙের স্বর্গ, তরুণ জাপানি ভদ্রলোকের বঙ্গীয় স্ত্রী শ্রীমতি হরিপ্রভা মল্লিক সর্বপ্রথম বাঙ্গালী মহিলা ঢাকা হতে পৌঁছালেন জাপান, চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে। তখন ব্রিটিশ ভারতের আমল ১৯১২ সাল, লিখলেন বাংলা ভাষায় জাপানের উপর প্রথম বই “বঙ্গো মহিলার জাপান যাত্রা”, জাপান আর বাংলার ভালোবাসা, প্রেম, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস আর আস্থার গল্প। বাংলাদেশ ও জাপানের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন। বাংলা আর জাপানের প্রাচীন সভ্যতাগুলি বন্ধুত্ব ও জ্ঞান চর্চার বন্ধনে আবদ্ধ। জাপানের আধ্যাত্মিক গুরু বোধিসেন ৭৫২ সাধারণাব্দে ভারত সফরে আসেন। যার মাধ্যমে জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রচার পায়। ব্রিটিশ আমলে এবং ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় বাংলাদেশ ও জাপানের সম্পর্ক সমস্যায় পড়ে। তা ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে উন্নত হয় যখন ঢাকায় জাপানের কনস্যুলার মিশন (সিএমজে) জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন শুরু করে। ভারত ও জাপানের সম্পর্ক উন্নত করার জন্য বাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অবদান অবস্মরণীয়, তারা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তেনশিন ওকাকুরা বিশিষ্ট জাপানি চারুকলা পণ্ডিত এবং তাইকান ইয়োকোয়ামা, জাপানি চিত্রশিল্পের মাস্টার, একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। বাংলার এই আলোকিতদের প্রত্যেকেই বাংলা ও জাপানের বন্ধুত্বে দৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব রেখে গেছেন। তাছাড়া জনাব তাদামাসা ফুকিউরা মুক্তিযুদ্ধের উপর অসাধারণ বই লিখেছেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু জাপান সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সাথে তার সংযোগ স্থাপনে ছিল কৌশলী । জাপান ১৯৭২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দেশগুলির মধ্যে জাপান অন্যতম। মূলত তখন থেকেই দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টোকিওতে দূতাবাস এবং জাপান বাংলাদেশে দূতাবাস খোলে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরপরই জাপান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশকে সাহায্য করতে, জাপানি শিক্ষার্থীরা তখন তাদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতার পরপরই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাপানের সাথে সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করতে জাপান সফর করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারের আমলেও বাংলাদেশ জাপানের সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। বাংলাদেশের প্রত্যেক সরকারপ্রধান জাপান সফর করেছেন।
স্বাধীনতার পরবর্তী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের একটি বড় দাতা দেশে পরিণত হয়েছে জাপান। স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাপান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে কাজ করতে শুরু করে, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে। জাপান বিগত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা করে গেছে। যার ফলে দুই দেশের মধ্যে একটি ফলপ্রসূ ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। জাপান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার এবং সহায়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, কারণ জাপান বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে সহযোগীতা করে যাচ্ছে ৷ এই সহায়তাগুলি আমাদের অর্থনীতি এবং অবকাঠামো পুনর্গঠনে সাহায্য করেছে ৷ বাংলাদেশকে দেওয়া সমস্ত ODA ঋণের মধ্যে বাংলাদেশে JOCV প্রোগ্রামটি খুবই প্রশংসনীয়। এটি উভয় দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একসাথে কাজ করার এবং পরস্পরের প্রজ্ঞা ও দক্ষতা বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়েছে। যারফলে বাংলাদেশের তরুণদের নিজ নিজ কারিগরি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে এবং উন্নত পেশাদার হিসাবে গড়ে উঠতে সক্ষম করেছে। ২০২০ সালের আগস্টে, বাংলাদেশ জাপান থেকে US$৩.২ বিলিয়ন মূল্যের বার্ষিক উন্নয়ন সহায়তা ঋণ পেয়েছে। যমুনা রেলওয়ে সেতু এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণসহ সাতটি বড় প্রকল্পের উন্নয়নে এই ঋণ দেওয়া হয়। তাছাড়া ৫ আগস্ট ২০২০ সালে, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ভাইরাসের আর্থ-সামাজিক প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য এবং COVID-19 সংকট ব্যবস্থাপনার জন্য ৩৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের জন্য বাংলাদেশের সাথে একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ত্রুটিগুলো প্রশমনে জাপান বাংলাদেশকে সহায়তা করে আসছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জাপানকে সমর্থন করেছে, যেমন ২০১৪ সালে জাপানের পক্ষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি অস্থায়ী আসনের জন্য তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার জন্য জাপানের আকাঙ্ক্ষাকেও সমর্থন করে। ২০১৪ সালের পিউ রিসার্চ জরিপ অনুসারে দেখা যায় ৭১ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক জাপানের প্রতি।
লেখক: অভিজিৎ বড়ুয়া অভি, কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম।
এসএ/