বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা


Janobani

জনবাণী ডেস্ক

প্রকাশ: ১২:৩৬ অপরাহ্ন, ১৫ই জুন ২০২৩


বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা
মো. সোহান হোসেন

মো. সোহান হোসেন: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও সর্বশেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু‌ শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন সফল রাজনীতিক। আঠারো বছর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাজনীতির মাঠের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অভিজ্ঞতা পূর্ণ করেছিলেন রাজনীতি সম্পর্কীয় জ্ঞান নিয়ে। ফলত তার চিন্তার একটা বড় অংশ ছিল রাজনীতি সম্পৰ্কীয়। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষার মর্যাদা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, এমনকি বাংলা শব্দ বিশিষ্ট নাম নিয়ে পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বরাবরই উচ্চকণ্ঠ। মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের সফল নায়ক হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে অবদান রেখেছেন।  


১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও সংস্কৃতিবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভাষার মাধ্যমেই জাতীয়তাবাদ বেশি বিকশিত হয়। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথম সারির নেতা। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি 'রাজবন্দিদের মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা'র দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন।


১৯৫৪-এর নির্বাচন

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা আইনসভার প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কয়েকটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব ছিলেন এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যুক্তফ্রন্টের দলগুলোর মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্রদল। ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু এ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে যোগ দেন এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।


আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুজিবনগর সরকার


১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে বিরোধী দলীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিকারবঞ্চিত বাঙালির পক্ষে যে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক যে পটভূমিতে ছয় দফা উপস্থাপন করা হয়েছিল তা সমগ্র শাসক এবং তাদের লেলিয়ে দেওয়া শোষক সম্প্রদায়কে কাঁপিয়ে তুলেছিল। দিনের পর দিন বাঙালিদের প্রতি অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপটেই ছয় দফা পেশ করা হয়েছিল। ২৩ বাঙালি। জাতীয়তাবাদের বিকাশে ছয় দফা কর্মসূচি এবং উক্ত কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন অধ্যায়।


১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান 

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেসব ঘটনার অবতারণা হয়, তন্মধ্যে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব পাকিস্তানের গণ মানুষের বিজয় অর্জিত হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, বাঙালি জাতি পাকিস্ত শাসনে আবদ্ধ থাকতে চায় না। এ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 


আরও পড়ুন:  সমুদ্রের অতল গহ্বরে লুকিয়ে আছে রহস্য



১৯৭০-এর নির্বাচন

১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেয়। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে । ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ঘোষণায় 'সমাজতন্ত্র' শব্দটি যুক্ত সবাইকে অবাক করে দেন। এ সময়ের বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারে তিনি যে বক্তব্য রাখেন তাও তার নতুন রাজনৈতিক গতিধারার গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন বহন করে।


১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ। একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল অচিন্তিত কালের সূচনা করেছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বজাবন্ধু মুক্তি সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান জানান। এই যুদ্ধে বক্তাবন্ধু সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও তার দিকনির্দেশনা ও আহ্বানে সমগ্র বাঙালি জাতি এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পূর্ব পরিকল্পনা মতো ২৫ মার্চে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চে প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ওয়ারলেসের মাধ্যমে দলের নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দেন যাতে স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। বঙ্গ স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমবার এবং সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয়বার প্রচার করেন। পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমান উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সৈনার আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। ফলে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। এ যুদ্ধে সফল হয় বাঙালি জাতি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচাইতে বড় ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় পরিচিতি নির্ধারণে তার চাইতে বেশি অবদান রেখেছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই ব্যক্তি, জীবনব্যাপী যিনি এই জাতির স্বার্থে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বিরাজ করেছিলেন এই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে। তিনি ছিলেন সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক, যা এক সর্বব্যাপী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সোপান রচনা করে দিয়েছিল।


জেবি/এসবি