স্বাবলম্বী হওয়ার জাল বুনছেন বেড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১২:৫২ অপরাহ্ন, ৬ই আগস্ট ২০২৩
পাবনার বেড়া উপজেলায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভাসমান, ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮৭৪টি পরিবার জায়গাসহ বাড়ি পেয়েছে। এক সময় যাদের বাসস্থান এবং মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলনা। বেশির ভাগই ছিল যমুনার পাড়ভাঙ্গা মানুষ। সব কিছু হারানো ভাসমান মানুষেরা বাসস্থান পেয়ে এখন শুরু করেছে স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রাম।
নতুন করে সাজিয়ে তুলছেন নিজেদের জীবন-সংসার। উপজেলার মাসুমদিয়া ইউনিয়নের ফকিরকান্দি আশ্রয়ণ প্রকল্পটি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ রয়েছে। প্রতি পাঁচটি বাড়ির জন্য একটি করে টিউবওয়েল। অনেকের ঘরে টেলিভিশন এবং কারো কারো ঘরে ফ্রিজও আছে। ঘরের সামনে বা পেছনের ফাঁকা জায়গায় অনেকে গোয়াল ঘর বানিয়ে নিয়েছেন।
আঙিনায় বেড়ে উঠছে লতানো লাউ-কুমড়ার গাছ। বাড়ির বারান্দায় কেউবা ছোট্ট দোকান সাজিয়েছেন। কেউ কেউ ঘরের ভেতর সেলাই মেশিনে জামা কাপড় সেলাই করছেন। এগুলো তাদের বাড়তি আয়ের পথ, যা তাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে এক পরিপাটি জীবনের। রূপপুর আশ্রয়ণের বাসিন্দা স্বামী পরিত্যক্তা লাইলি খাতুন (৩৫)।
৭৫ বয়সের বৃদ্ধা মা আলেয়া খাতুন ও ৭ বছরের ছেলে আসগর আলীকে নিয়ে তার সংসার। নদীভাঙনে ছোট ছেলে, স্বামী ও সংসার হারানো লাইলি এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর পেয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। লাইলির ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল রঙিন টেলিভিশন।
নিজের পোষা ছাগল বিক্রি করে ছেলে ও মায়ের জন্য এটি কিনেছেন তিনি। ঘরে তার একটি সেলাই মেশিনও আছে। সেটি দিয়ে কাঁথা তৈরির কাজ করেন। এখন মা ও ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালো আছেন বলে জানালেন তিনি। লাইলির মা আলেয়া খাতুন বললেন, এক সময় আমাদের বাড়ি ছিল। ফসলী জমি ও গোয়ালে গরু ছিল।
প্রায় ৩০ বছর আগে যমুনার ভাঙনে সব কিছু হারিয়েছি। খাসজমির ওপর ছাপরা ঘর তুলে থাকতাম। ১৬ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। এরপর মেয়ের সংসারে আসি। সে সংসারও ভেঙে গেল যমুনায়। ছেলেরা দেখত কিন্তু এখন তাদেরও সামর্থ্য নেই।
কৃষি শ্রমিক রফিকুল ইসলাম অন্যের জমিতে মজুরের কাজ করেন। কাজ না থাকলে নাকালিয়া বাজার থেকে পাইকারি মাছ কিনে এনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেগুলো খুচরা বিক্রি করেন। আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন তিনি ও তার স্ত্রী আয়েশা খাতুন। আগে এখানেই খাস জায়গায় ছাপরা ঘর তুলে থাকতেন তারা। এখন পাকা ঘর পেয়েছেন। স্ত্রী আয়েশা বলেন, এনজিওর ঋণ নিয়ে গরু কিনে মোটাতাজা করছি , দুই ছেলে এক মেয়ে তাদের।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার স্বপ দেখছি এখন। জাতসাখিনী ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা স্বামীহারা নাসিমা বেগম তার একটি মেয়ে প্রতিবন্ধী। জায়গা সহ একটি ঘর পেয়েছেন এখানে। পাকা ঘরের সামনের আঙিনায় শাক-সবজি চাষ করে মা-মেয়ে ভালোই আছেন। তন সন্তানের মা আকলিমা খাতুন আগে ভিক্ষা করতেন আশ্রয়ণ প্রকল্পে তিনিও একটি পাকা ঘর পেয়েছেন।
এখন তাকে আর ভিক্ষা করতে হয় না। এলজিইডির অধীনে সড়কে তিনি দিন মজুরের কাজ করেন। ছেলেটি হোটেলে বয়ের কাজ করে। আর ছোট দুই মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী হাসনা বেগম নিজের কিংবা স্বামীর ভিটেমাটি না থাকায় জীবনের বেশির ভাগ সময়ই অন্যের জায়গায় কুঁড়েঘর তুলে কাটিয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে পেয়েছেন নিজের জন্য একটি স্থায়ী ঠিকানা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা জমিলা খাতুন (৬৭) বলেন, সারের বস্তার কাগজের ছাউনি দিয়ে কোনোভাবে মাথা গুঁজে থেকেছি এতকাল এখন মাথা গোঁজার জন্য একটি ঠিকানা পেয়েছি। কী যে ভালো লাগছে। আর কিছু চাই না আমি। সরেজমিনে একাধিক আশ্রয়ণে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা ইতোমধ্যে নিজেদের ঘরের আঙ্গিনায় শাক-সবজির আবাদ করেছেন। কেউবা হাঁস-মুরগি, ছাগল-গরু পালন করছেন। সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন সবাই মাথার ওপর ছাদ পেয়ে সেই স্বপ্নগুলো আরো রঙিন হচ্ছে, সজীব হচ্ছে, আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন সবাই।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলি বলেন, জীবনে যত মানবিক কাজ করেছি এটাই হলো তার মধ্যে সেরা। এই সেরা কাজ করার অনুভূতি একেবারেই ব্যতিক্রম। ছিন্নমূল ও ভূমিহীন মানুষদের একটি করে ঘর দিতে পেরে ভালো লাগছে। তাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করছি, তা সত্যি অভাবনীয়।
বেড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম জানান, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে আশ্রয়ণের মোট ৮৭৪টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণে প্রয়োজন হয়েছে এক হাজার ৮৫১ দশমিক ৩১ শতাংশ জমি। এর মধ্যে খাস এক হাজার ১০০ শতাংশ ও কেনা জমি রয়েছে ৭৫১ দশমিক ৩১ শতাংশ। এসব আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা এখন কেউ বসে নেই। সবাই কিছু না কিছু করছেন।
স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন। একটি ঘরই তাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তারা সন্তানদের নিয়ে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছেন।
উল্লেখ্য, আগামী ৯ আগষ্ট সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুফলভোগীদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলে এই উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করবেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
আরএক্স/