কারাম পর্ব উৎসব পালন উপলক্ষে মেতে উঠেছে সমতলের আদিবাসীরা
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪:৩১ অপরাহ্ন, ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৩
ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাসকে আমরা শরৎকাল বলে থাকি। শরৎ মানে ঋতুর রানী,রুপের সমারোহ, সোনা রঙের সূর্যালোকে মুগ্ধ করা মোহ। দূর নীলিমায় সাদা মেঘের উদ্ভাসিত মেলা, মাঠে-ঘাটে কাশফুলেরা দোলে সারাবেলা। শাপলা,পদ্না, শিউলী আর কামনী,জুই ফুলে বাংলার রুপ অপরুপ হয়ে উঠে মায়াবী তুলতুলে।
এই শরৎকালের ভাদ্র মাসের শেষে অর্থ্যাৎ আগামী ০২-০৩ আশ্বিন-১৪৩০ বঙ্গাব্দ ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর-২০২৩ রোজ রবিবার-সোমবার রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলাসহ সকল সমতলের আদিবাসীরা রাতভর মেতে উঠে কারাম নৃত্য উৎসবে। সারা মাস ধরে চলে নাচ গান। ভাদ্র মাসের একাদশী ও ভরা পূর্ণিমায় কারাম উৎসব পালিত হয়। মহাসমারোহের সাথে মাদলের তালে ঝুমুরের নৃত্যতে মেতে উঠে আদিবাসী গ্রামগুলো। কারাম পর্ব মুন্ডা (পাহান),উড়াওদের উৎসব। তবে সমতল তথা উত্তরবঙ্গে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে মুন্ডা (পাহান),উরাও, সাঁওতাল, মালো, মাহাতোসহ অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির মানুষ কারাম উৎসব পালন করে থাকে। উৎসবটি ভাদ্র একাদশীতে ও পূর্ণিমায় হয় বলে “ভাদই” কারাম পর্ব ও একাদশী কারাম পর্ব নামে অভিহিত করা হয়।
কারাম উৎসব মানেই বৃক্ষ পূজা। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে স্বরণ করে বৃক্ষকে রক্ষা-কর্তা হিসেবে কারাম উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “জীবে প্রেম করে যে জন সেই জন সেবীছে ঈশ্বর”।
এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাহারী রংঙের লাল-নীল ও বিভিন্ন রংঙের শাড়ী পড়ে আদিবাসী সমাজের কিশোর-কিশোরী,যুবক-যুবতী ও নারী-পুরুষ হয়ে উঠে নৃত্যচঞ্চল ও সঙ্গীতমুখর। আগে উত্তরবঙ্গের প্রায় সকল আদিবাসী গ্রামেই কারাম পর্ব পালন করা হতো। তবে দিনে দিনে নানা কারণে কারাম পরব তার নিজস্ব সত্ত্বা হারিয়ে ফেলছে।
উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা নানান আয়োজনে সনাতন ধর্মের অংশ হিসেবে এই কারাম উৎসবটি পালন করে থাকেন। গ্রামের দশজন মিলে যখন ভাদ্রের একাদশীতে কারাম করা হয় তখন তাকে “দশওয়ালী” কারাম বলে। পারিবারিক ও ব্যক্তিগতভাবে আয়োজিত কারাম “আপন” কারাম নামে অভিহিত ও পরিচিত। ভাদ্র মাসের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত আয়োজিত কারামই হলো “ভাদই” কারাম।
এটি দশে মিলে করা হয় বলে দাশ(দশ) কারাম নামেও পরিচিত। শারদীয় দূর্গাপূজার সময় আদিবাসীরা দশমীতে আয়োজন করেন“দশই” কারাম। ঢোল,মাদল, নাগরা(টমাক),ঝুমুর-জুড়ি এগুলো বাজিয়ে আদিবাসী নারী-পুরুষেরা কারাম তথা ঝুমুর নাচের আয়োজন করেন। ভাদ্র মাসের অন্ধকারে(আমাবস্যা) তিথীতে “জিতিয়া” কারাম করা হয়।
এতে সাতটি ঘীয়ের বাতি লাগে। তবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ আদিবাসীরা কারাম পুজা করেন ভাদ্র মাসে। কারাম গাছকে কেন্দ্র করে কারাম উৎসবের আয়োজন। প্রতিটি আদিবাসী গ্রামের এক বৈশিষ্ট্যময়ী দৃশ্য হলো কারাম বৃক্ষ। পবিত্র এই গাছকে কারাম পর্বের মধ্য দিয়েই আদিবাসী নারী-পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে বাচিঁয়ে রাখেন।
পূর্বে প্রায় সকল আদিবাসী গ্রামগুলোতেই বাড়ী বাড়ী কারাম গাছ ছিল। এখন অনেক গ্রামেই কারাম গাছ নেই। ভাদ্র মাসে এর গাছ ভর্তি কদমের মত রোয়া ওঠা এক ধরনের হলুদ রঙের ফুল থাকে। আদিবাসী গ্রাম ছাড়া প্রাকৃতিক বনে এই গাছ একে বারেই বিলুপ্ত। কারাম পর্ব পালনের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে কিছু মিল-অমিল দেখা যায়। কারাম উৎসবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর প্রকৃতি ও পরিবেশ ঘনিষ্টতা।
কারাম পর্বনের জন্য কারাম গাছের ডাল, সিন্দুর,গাঁদা ফুল, যব-খান সরিষাসহ নানান শষ্য, ফসলের বীজ, সাদা শাপলা ফুল, শসা, হলুদ, দূর্বাঘাস,আতব চাল, ধুপ দিয়ার প্রয়োজন হয়। একাদশী বা পূর্ণিমার রাতে কারাম ডালটি মাটিতে পুঁতা হয়। এরপর “আখড়ে বন্দনা কের স্বরসতী মায়কের সভে রিবোনধনা মিরজোনারি গই মদনে ঝুমার লাগাল বারি” এই বন্ধনার গীত ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর তালে তালে নাচ আর গান মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ।
বন্ধনার বাংলা অর্থ হলো-আখড়া বন্ধনা করি স্বরসতী মায়ের আশির্বাদ নিয়ে প্রেমের দেবতা শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার করি। এ উৎসব কারাম পুজা(ভাদাই)পর্বের একটি ঐতিহ্যের প্রতি সকল আদিবাসীদের সজাগ হতে হবে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ মিঠাপুকুর উপজেলা শাখার সভাপতি মাষ্টার মোহন লাল কুজুর, সাধারন সম্পাদক গোলাপ বাড়া, ১৪ নং দূর্গাপুর ইউনিয়ন আদিবাসী উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি বাবলু টপ্য, স্বপ্নচূড়া ফাউন্ডেশনের সভাপতি পলাশ টপ্য,সাধারন সম্পাদক টুলিপ এক্কা, আদিবাসী নেতা শ্রী সুভাষ চন্দ্র উড়াও, প্রফুল্ল্য টপ্য, রবি বাকলা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ রংপুর জেলা শাখার মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা শ্রীমতি আলোতি খালকো, কার্যকারী সদস্য শেফালী মার্ডিসহ আরো অনেকে জানান, প্রাচীন কাল থেকে এই কারাম উৎসব সমতলের আদিবাসীরা এই পর্বের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ধর্ম,মাতৃভাষা, শিক্ষা,সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য পালন করে আসছে এবং এই কারাম পর্ব প্রতিটি আদিবাসী নারী-পুরুষ,শিশু,কিশোর-কিশোরী,যুবক-যুবতীদের জীবনে চির স্মরনীয় হয়ে থাকুক।