রেডিও যেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাদুর বাক্স
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫:০৮ অপরাহ্ন, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৩
এক সময় দেশ-বিদেশের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও। তখন খবরের সময়ে শহর কিংবা গ্রামের লোকজন একটা নির্দিষ্ট স্থানে খবর শোনার জন্য সমবেত হতো। কারণ তখনো সবার ঘরে ঘরে রেডিও’র প্রচলন ছিল না।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কুলাউড়া, ব্রাক্ষণবাজার, আদমপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে যার বাড়িতে রেডিও থাকতো সেই পরিবারকে অনেক ধনী ব্যক্তি বলে মনে করতো সেই সময়ের মানুষেরা। এরপর অবশ্য ধিরে ধিরে রেডিও’র প্রচলন বৃদ্ধি পেয়ে সবাব ঘরে ঘরে জায়গা করে নিয়েছিল। তখন প্রত্যেকেই নিজ বাড়িতে রেডিও শুনতো।
অনেকেই শখ করে বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রেডিও (বেতার) দিত। সন্ধ্যা নামলেই শহর কিংবা গ্রামে মানুষেরা দল বেঁধে জড়ো হয়ে খবর শুনতো। এক সময় শুধু সন্ধ্যার খবর শুনার জন্য এক এলাকার লোকজন অন্য এলাকায় গিয়ে খবর শুনতো।
কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের ৯৫ বছর বয়সী যমুনা গোয়ালা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচারকৃত খবর শোনার একমাত্র মাধ্যমই ছিল রেডিও। যে খবর শুনে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উজ্জ্বিবিত হয়েছিল। খবর শুনে সবাই সর্তক হয়ে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতো নিজেকে । তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি রেডিওতে শুনে লাখো বাঙ্গালি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধের সময় খবর শুনার জন্যে সন্ধ্যা বেলায় সবাই সমবেত হতো। রাত্রের বেলা পাক-হানাদার বাহিনীরা মুক্তি সেনাদের ভয়ে গ্রামে আসতো না, তাই সন্ধ্যায় নিশ্চিন্তায় খবর শুনতে পারতাম।
চিকিৎসক সঞ্জয় যাদব বলেন, ২০১০ সালের দিকে আমাদের ঘরে রেডিও ছিলো, আর সেটি ব্যাটারি দিয়ে চালানো হতো। কোথাও কোথাও দোকানে, চায়ের স্টলে দেখা যেতো। কিন্তু এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। শহরে তো নেই, গ্রামেও হারিয়ে বসেছে সেই ঐতিহ্য।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় রেডিও এখন বিলুপ্তির পথে। এখন আর আগের মতো রেডিও'র আওয়াজ কানে আশে না! এখন আর আগের মতো সমবেত হয়ে কেউ সন্ধ্যার খবর শুনার অপেক্ষায় থাকে না। ব্যাপক পরিবর্তন এখন ঘরে ঘরে টিভি। নেই সবার ঘরে রেডিও।
রেডিও শ্রোতা সন্তষ জানান, ১৯৯০-২০০০ এর দিকে সবার কাছে রেডিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সবার ঘরে ঘরে রেডিও ছিলো, তারা রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত, সুখী সংসার, দর্পন, ছায়া ছবির গান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নাটক শোনায় রেডিও’র প্রচলন ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
তবে সেই জনপ্রিয়তা তরুন প্রজন্ম বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। সময়ের পরিবর্তনে তারা রেডিও ছেড়ে টেপ রেকর্ডার (ক্যাসেট) এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরবর্তীতে সেটিরও বিলুপ্তি ঘটিয়ে মোবাইল তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এখন মোবাইলে অনেকেই বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা শুনে থাকে। তবে এর সংখ্যা হাতে গুনা কয়েকজন।
এফ এম রেডিও’র নিয়মিত শ্রোতা কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের সৌরভ, মোশাররফ, বিশাল জানান, বর্তমানে বিজ্ঞানের আবিষ্কারে ফলে অতি সহজেই মোবাইল এফ.এম-এর মাধ্যমে আমরা রেডিও অনুষ্ঠানগুলো শুনতে পাই। ফলে নতুন করে আর রেডিও ক্রয় করে খবর শোনার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে দিন দিন আমাদের সেই ঐতিহ্যবাহী রেডিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
একই ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের মোঃ সাইস্তা মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম জানান, রেডিও’র গুরুত্ব এখনো কমে যায়নি। যাদের কাছে এটির গুরুত্ব থাকা প্রয়োজন তাদের কাছে এখনো এর যথাযথ গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই স্বাধীন বাংলার প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিও’র মাধ্যমেই প্রচার হওয়ার কথা অনেক মুরব্বিদের কাছে সে সময়ের কথা শুনেছি। তাই আসুন আমরা সবাই আমাদের হারিয়ে যাওয়া এই রেডিওটির গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনি।
এই বেতার যন্ত্রটিকে টিকেয়ে রাখাতে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী ব্যাবস্থা গ্রহন করা উচিৎ বলে মনে করেন রেডিও প্রেমী সচেতন মহল।
জেবি/এসবি