খেজুর গাছের আগাম পরিচর্যায় ব্যস্ত গাছিরা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩:৪৮ অপরাহ্ন, ১০ই নভেম্বর ২০২৩


খেজুর গাছের আগাম পরিচর্যায় ব্যস্ত গাছিরা
খেজুর গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত গাছি। ছবি: সংগৃহীত

শাহাদাৎ হোসেন লাভলু:  শীত আসতে না আসতে গাছিরা আগাম খেজুর গাছ পরিচর্চায় ব্যস্ত সময় পার করছে। দিনে গরম সন্ধ্যা হলেই যেনো শীতের আগমনী বার্তা কুয়াশার সাথে শীত অনুভূত হচ্ছে। সকালের শিশির ভেজা ঘাস জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। অনেকেই রাতে বৈদ্যুতিক ফ্যানের হাওয়া/বাতাস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। 


আর যারা বৈদ্যতিক ফ্যানের হাওয়া/বাতাস খাচ্ছে তারা নকশী কাঁথা বা পাতলা কম্বল ব্যবহার করছে। আর এ সবই দিচ্ছে শীত আগমনের বার্তা। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার গাছিরা আগাম খেজুর গাছ চাছাছোলা ও পরিচর্চায় শুরু করেছে এবং তারা ব্যস্ত সময় পার করছি। 


কে কতো আগে খেজুর রস সংগ্রহ করতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় চলছে গাছিদের মাঝে। শীতের মৌসুম শুরু হতে না হতেই আগাম রস পাবার আশায় দেশের অধিকাংশ জেলার গাছিরা গাছের পরিচর্যা ও গাছ প্রস্তুত করতে শুরু করেছে। গাছিরা হাতে দা নিয়ে ও কোমরে ডোঙ্গা/ রশি বেঁধে নিপুন হাতে গাছ চাছাছোলা করছে। 


শীতের মৌসুম মানেই খেজুর গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে পুরো গ্রাম পাড়া মহল্লায়। আর শীতের সকালে ঠান্ডা খেজুর রস খেতে কার না ভালো লাগে, খেজুরের রসের তৃপ্তি-ই আলাদা। এছাড়া খেজুর রসের ক্ষির, পায়েসের মজার কথা সবার জানে, শীতকাল মানেই খেজুর রস, গুড়, পাটালির মেলা। 


শীত মরসুমে প্রতিদিন গ্রামের কোনো না কোনো বাড়িতে খেজুর রস, গুড়ের খাবারের আয়োজন চলে। খেজুরের শুধু রসই নয়, পাটালি, নলেন গুড় ছাড়া জমেই ওঠেনা। ধারালো দা দিয়ে খেজুর গাছের সোনালী অংশ বের করা হয়, যাকে বলে চাঁচ দেয়া, তার সপ্তাহ খানেক পর বাঁশের তৈরি নোলন স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হবে সুস্বাদু খেজুর রস আহরণের কাজ।


দেশে বিভিন্ন জেলা উপজেলা গ্রাম পাড়া মহল্লা গুলোতে ও প্রতিটি মাঠের ক্ষেতের আইলে, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে-অযন্ত্রে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুরের গাছ দেশের অর্থনীতিতে আশীর্বাদস্বরুপ।

 

শীত মরসুমে রস-গুড় উৎপাদন করে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে দেশের কয়েক কোটি পরিবার। 


খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি উৎপাদনে প্রসিদ্ধ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত  জেলা, যশোর শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ফরিদপুরসহ  দেশের প্রতিটি জেলায় কম বেশি এই খেজুর রস সংগ্রহ করছে গাছিরা।

 

জেলা উপজেলা গ্রাম পাড়া মহল্লায় রস, গুড় ও পাটালি তৈরি হয়, তা নিয়ে শীত মরসুমে রীতিমত কাড়াকাড়ি শুরু হয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয় এই খেজুর গুড়-পাটালি। দেশের বাইরেও এর বেশ কদর রয়েছে। শীত মৌসুম খেজুরের রস দিয়ে গ্রামীণ জনপদে শুরু হয় শীতের আমেজ। 


শীত যতো বাড়বে খেজুরের রসের স্বাদ ততো বাড়বে। সুস্বাদু পিঠা ও পায়েস তৈরিতে আবহমান কাল থেকে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে খেজুরের গুড় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার কারিগরদের দানা গুড়, পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যাপক সুনাম থাকায় খেজুরের গুড় পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশ সহ বিশ্বজুড়ে।


যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার  (গাছি) সিরাজুল ইসলাম জানান, চলতি মরসুমে ৪শ টি গাছ থেকে খেজুরের রস আহরণ করবেন। খেজুর গাছের রস, গুড়-পাটালি বিক্রয় করে খরচ বাদে প্রায় দেড় ২ লাখ টাকা লাভের আশা করছি।


কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার (গাছি) হাবিবুর রহমান জানান, চলতি মরসুমে প্রায় ৩শ টি গাছ প্রস্তুত করেছি। বাজার মূল্য ভালো হলে খরচ বাদে ২ টাকার গুড় বিক্রি করার আশা করছি। 


চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ছন্নত আলী বলেন, এই মুরসুমে আমি ৬শ অধিক গাছ তুলেছে বাজার মূল্য ভালো হলে খরচ খরচ বাদে আমার সাড়ে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা লাভ হবে।


একই উপজেলার ওমর আলী বলেন এবার আমি দুই শতাধিক গাছ তুলেছি আমি আশাবাদী খরচ খরচা বাদী এবার আমার এক লক্ষ টাকার উপরে লাভ হবে।  সে আরও বলেন, এবার এলাকায় ঢাকার ব্যাপারী এসেছে, তারা চুয়াডাঙ্গাসহ আশেপাশের জেলায় চুক্তিমূল্যে খেজুর গাছ ক্রয় করেছে। তারা এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করবে। আর সে সব গুড় নাকি বিদেশে রপ্তানি করবে। 


ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার  মদনপুর গ্রামের গাছি বলেন, এবার আমি সাড়ে চারশো টি মত গাছ প্রস্তুত করেছি আমি আশা করছি এবার এই খেজুর গুড় আমি বিক্রয় করে অনেক লাভবান হব, এবং আমাদের জেলার রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বাইরের রাষ্ট্রে ভালো কদর রয়েছে।


শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার গাছি ফিরোজ আলম জানান, এবার আমি একশটির বেশি গাছ প্রস্তুত করেছি রস গুড় পাঠালি বিক্রয় করে এবার আমি লাভবান হব।


এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলিত মরসুমে জেলার ৪টি উপজেলায় ২ লাখ ৬৬ হাজারের মতো খেজুরগাছ থেকে কৃষকরা রস আহরণ/সংগ্রহ করছে। যার প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে গুড়ের মরসুম। এই মরসুমে গড়ে আড়াই হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হবে। 


চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, এবার চুয়াডাঙ্গা জেলা জুড়ে খেজুরের রস আহরণের জন্য গাছিরা আগাম খেজুর গাছ গুলো প্রস্তুত করছে। সঠিক পদ্ধতিতে, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে যেন রস-গুড় উৎপাদন করে গাছিরা-এ জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তিনি আরু জানান, ভোক্তারা যাতে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রস্তুতকৃত খেজুরের রস-গুড় পেতে পারে এজন্য কাজ করে  থাকে চুয়াডাঙ্গা কৃষি বিভাগ। মরসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে চলতি মরসুমে ২ লাখ ৬৬ হাজারের মতো খেজুরগাছ থেকে গড়ে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হবে। এছাড়া গাছিরা খেজুর রস-গুড়ের বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরি করে নিকটস্থ’ বাজারে বিক্রয় করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকে।


আরএক্স/