জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতের আগমনী ছোঁয়া
ক্যাম্পাস প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩:৫৪ অপরাহ্ন, ১৯শে নভেম্বর ২০২৩
শীতের খেজুর রস,
দেখলে কে না হয় খুশিতে
চঞ্চলা সরস?
থাকলে সাথে উত্তরী,
আর কি খাটে কথার মাঝে
হিমের জারি-জুরি!
বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ মাস থেকেই যেন শিতের আগমনী আমেজ ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শীত যেন একটু আগেই চলে এসেছে সময়ের পরিক্রমায় হেমন্তের বিদায়ী ঘন্টা বাজার আগেই শীতের জানান দিচ্ছে কোমল স্নিগ্ধ প্রকৃতি। জাবিতে শীত এসেছে দিগন্ত জোড়া মাঠের প্রান্তে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে নয়, জাবির সাতশো একরের ক্যাম্পাসে শীত এসেছে পরিযায়ী পাখির আগমন, শিক্ষার্থীদের পদচারণা আর প্রাণ প্রকৃতির নবসাজে উদ্দেলীত তারুণ্যে। শহরে এখনো শীতের তীব্রতা ততটা নয়, তবে জাহাঙ্গীরনগরের বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন।গোধূলির সোনালী সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই মাঝারী কুয়াশার চাদড়ে আঁকড়ে ধরা প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যায় শীত এসে গেছে। জাবিতে যেন শীতের ভরা মৌসুম চলছে।
জাবি ক্যাম্পাসে যে শীত এসে পড়েছে তা বোঝা যাচ্ছে গোধূলীর সোনালী সূর্য অস্ত না যেতেই মাঝারি কুয়াশার চাদরে আকড়ে ধরা প্রকৃতিতে, ভোরে সূর্য রশ্মির গাছে পাতার হালকা শিশিরে প্রতিফলিত হওয়ার দৃশ্যে। হালকা হিমেল বাতাসে মৃদু কাঁপন ধরানো অনুভূতি ক্যাম্পাসবাসীর গায়ে শীতের ফ্যাশনের বার্তা জানিয়ে দেয় শীতের আগমনী ঘণ্টা। ফ্যাশন সচেতন শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে নানা ডিজাইনের হুডি ও শীতের গরম কাপড়ের যোগাড়ে। নানান ঢঙের পোশাক দিয়ে শীতকে শুধু প্রতিরক্ষাই নয় বরং শীতের কাপড়কে কিভাবে আরো আকর্ষণীয় করে তোলা যায় সে বিষয়ে নিরন্তর চেষ্টার কোন কমতি নেই জাবি শিক্ষার্থীদের।
শীত মানেই নতুন এক আমেজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও খেজুর গাছ নেই তাই বলে খেঁজুরের রস থেকে বঞ্চিত নয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের গ্রামগুলো থেকে সংগৃহীত টাটকা খেঁজুরের রস পাওয়া যায় পরিবহন চত্বরে খুব সকালে, যা শীতের আমেজকে আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলে! জাবির বিভিন্ন ধরনের পিঠা, কুয়াশার চাদরে মোড়ানো ক্যাম্পাস, শিশিরে ভেজা পল্লব শীতের আমেজকে জানান দেয় ভিন্ন আঙ্গিকে। শীতের স্নিগ্ধ মনোরম ছোঁয়া লেগেছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্বরে। জাবির বটতলাতে বেড়ে গেছে খাবারের নতুন নতুন পদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বটতলার খাবারের স্বাদ গ্রহণ না করে চলে যান এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বটতলার বাহারী খাবারের মধ্যে অন্যতম ঢেড়স, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা, বরবটি, টমেটো ,লাউ, শিম পালং ইত্যাদি শীতের শাক-সবজি সাথে আছে হাজারো রকমের সুস্বাদু ভর্তা। জাবির বটতলার বিশেষ আকর্ষণ এই ভর্তা। শীতে বাহারি পদের ভর্তায় বরাবরই মুগ্ধ সবাই। এছাড়া শীতের বিভিন্ন ফল যেমন জলপাই, চালতা , সফেদা , তেঁতুল ফল এবং বিভিন্ন পদের আচারও পাওয়া যায় জাবি ক্যাম্পাসে।
স্বভাবতই প্রকৃতির সাথে মানবমনের রয়েছে এক নিগূঢ় যোগসূত্র। শিশির ভেজা প্রকৃতি, কুয়াশাচ্ছন্ন ঘাসের পাতার সূর্যালোকিত হয়ে হীরকের মত ঝলমলানী, পত্রশূণ্য গাছ-গাছালি যেনো প্রতিটি বাঙ্গালির মনেই দাগকাটে একটু বৈচিত্রপূর্ণভাবে। ঠিক একইভাবে বহিরাঙ্গিক সকল রূপ নিয়ে প্রসন্নতা-বিষণ্ণতার আলপনা আঁকতে বৈচিত্রময়তার সর্বোচ্চ সমাহার নিয়ে শীতের আগমন ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। যদিও আমরা বলে থাকি প্রকৃত শীতের ছোঁয়া পেতে গ্রামের কোনো বিকল্প নেই কিন্তু বিচিত্রময় প্রকৃতি ও পরিবেশের অভয়ারণ্য প্রায় সাতশো একরের এই ক্যাম্পাসে শীতের আগমন কোনোভাবেই গ্রাম থেকে কোন অংশে কম নয়।
ক্যাম্পের শিক্ষার্থীদের অকৃতিম ভালোবাসা জাবিকে পরিনত করেছে এক আধুনিক গ্রামে।
সবুজের নৈস্যর্গিক সমারোহ ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীত আসে চিরচেনা রূপের বাইরে আরও কিছু মুগ্ধতা নিয়ে। জাবির পুকুরে লাল শাপলা হাসিমুখে স্বাগত জানায় শীতকে।শীতকালে জাবি ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ফুলের উত্থান ঘটে। গাঁদা, লাল শাপলা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, বিশ্বসুন্দরী, জিনিয়া, দোপাটি, জুঁই, চামেলি, টগর, জবা প্রভৃতি ফুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হল, অ্যাকাডেমিক ভবন, রাস্তার পাশে শোভা বর্ধন করে। জেনারেটরের লেকে কচুরীপানার সাথে ফুটে ওঠে সাদা ও লাল শাপলা, শাপলার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মোহনীয় ও সুগন্ধযুক্ত বেগুনি শাপলা যা দেখলে যে কারও মনে পড়বে শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোর কথা, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বকুনির ভয়কে উপেক্ষা করে খালে-বিলে কলার ভেলা, তালের ডোঙা অথবা ছোট্ট নৌকায় চেপে শাপলা বা কচুরিপানা ফুল তোলার স্মৃতি!
সকালের মৃদুমন্দ নির্মল বাতাস আর কুয়াশা জড়ানো হিমেল হাওয়ার স্পর্শে অতৃপ্ত হৃদয় মুহূর্তেই তৃপ্ত হয়ে যায় পুরো জাবি ক্যাম্পাস। কুয়াশা জড়ানো শীতল অনুভূতির অবসান ঘটে সকালের রক্তিম সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দিতেই।একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু’ কবিতাটির প্রতিফলন দেখা যায় জাবির কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। সোনালী রোদের কিরণ পড়তেই জাবির কেন্দ্রীয় মাঠের শিশির জমা ঘাসগুলো চকচক করে ওঠে। শহরের ভেতর নানা যান্ত্রিকতার মাঝেও জাবিতে যেন এক গ্রাম্য অনুভূতি।
জাবিতে শীতকাল মানেই হলো উৎসবের ধুম। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন: জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, জলসিঁড়ি, চিরকুট, ধ্বনি, গীতনাট, জুডো, জাডস প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হেমন্তের মধ্যম সময় থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে ক্যাম্পাসবাসীকে শীতের আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয়। ছোটোবড়ো আধা শতেকখাকি উৎসবের মধ্যে সবচাইতে আকর্ষনীয় হয়ে থাকে হিমউৎসব। তিনদিনব্যাপী এই উৎসব তুলে নিয়ে গ্রামবাংলার পুরাতন কিছু সংস্কৃতি যেমন: সাপখেলা, লাঠিখেলা, পুতুলনাট্য ইত্যাদি।এছাড়াও প্রতিবছর আয়োজন করা হয় পাখিমেলার। পাখি মেলা শুধু অতিথি পাখিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই নয় সেই সঙ্গে অতিথি পাখি সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়াও এই উৎসবের অন্যতম উদ্দেশ্য। শুধু পাখি মেলা নয় প্রতিবছর শীতের সময়ে আয়োজন করা হয় প্রজাপতি মেলার। হারিয়ে যাওয়া এসব সংস্কৃতির ছোঁয়ায় পুরাতন ঐতিহ্যগুলো যেনো তরতাজা হয়ে উঠে জাবিতে। আর এজন্যই ক্যাম্পাসসহ আশেপাশের এলাকার মানুষও একটি বছর অধীর আগ্রহে উদ্দীপনা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কবে শীতের আগমন ঘটবে এই জাবিতে!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ পরিযায়ী পাখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’র পেছনের লেক, জাহানারা ইমাম এবং রেজিস্ট্রার ভবন সংলগ্ন লেকে আগমন ঘটেছে অন্তত কয়েক হাজার অতিথি পাখি। উপযুক্ত পরিবেশ আর নিরাপদ আশ্রয়ে এসব অতিথি পাখি এখানে নির্ভাবনায় মেতে উঠে কলকাকলি ও জলকেলিতে। কেউ আবার ডুব সাঁতারে ব্যস্ত। কখনও কখনও চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে জাবি ক্যাম্পাসের নির্মল মুক্ত আকাশে। কখনোবা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে খাবার জোগাড় করতে। তাদের এ কার্যকলাপ দেখতে এবং ক্যামেরাবন্দি করতে ক্যাম্পাসের অধিবাসীরা ছাড়াও প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য পাখিপ্রেমী পর্যটকের সমাগম ঘটতে শুরু করেছে জাবি ক্যাম্পাসে। শীতের আগমনী বার্তা জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস কে দিনাজপুরের স্বপ্নপূরী নগরীকেও হার মানায়।
তাহলে পরিযায়ী পাখিরাই কি জাহাঙ্গীরনগরে শীতের সকাল দেখার আমন্ত্রণ জানায় পর্যটকদের?
জেবি/এসবি