মাদকাসক্ত নয়, সুস্থ থাকুক শিশু-কিশোর


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


মাদকাসক্ত নয়, সুস্থ থাকুক শিশু-কিশোর

সমাজে বাড়ছে কিশোরগ্যাং অপরাধ। একটা  সময় ছিল যখন রাস্তাঘাটে কিশোর মানেই লাজুক লাজুক ছেলেরা। সেটার জায়গা দখল করেছে এখন উদ্ভট চুলের কাটে কিশোররা। অভিভাবকসহ সমাজ এখন ভাবছে কিশোরদের এমন অবস্থার কারণ কী? 

ঘরে বন্দি থেকে বড় হওয়া, খেলার মাঠ না পাওয়ার কারণতো আছেই। এছাড়া মাদকাসক্ত হওয়া এর একটা বড় কারণ বলেও ধরা হয়, যার দরুণ কিশোর-কিশোরীরা বিপথে পা বাড়াচ্ছে নিজেদের অজান্তে।

কিশোর-কিশোরীদের মাদকাসক্তি বলতে আমরা কী বুঝি? মাদকাসক্তি বলতে বোঝায় মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশাকে। যেসব দ্রব্য সেবন করলে আসক্তির সৃষ্টি হয়, জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা ও স্মৃতিশক্তি কমে যায়, সেগুলো বাংলাদেশে অভিহিত করা হয়েছে মাদকদ্রব্য হিসেবে। সিগারেট, বিড়ি, তামাক, মদ, তাড়ি, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, মারিজুয়ানা, মরফিন, ইয়াবা ইত্যাদি হলো মাদকদ্রব্য।

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) এর প্রতিবদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের এক বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখের বেশি। এ সকল মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কিশোর ও তরুণ। ২০২১ সালে এসেও কিশোর ও তরুণ মাদকসেবীদের এই পরিসংখ্যান অপরিবর্তিত রয়েছে। জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ২৫ লাখ শিশু-কিশোর তথা অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী মাদকসেবী রয়েছে।

ড. অরুপ রতন কিছু বিশ্লেষণধর্মী কারণ তুলে ধরে বলেন, “শিশু-কিশোরদের মাদকসেবনের পেছনে নানা ধরনের কারণ থাকতে পারে। প্রথমবার শিশু-কিশোররা মাদকের সঙ্গে পরিচিত হয় সাধারণত কোনো সোশ্যাল সেটিংসে, যেখানে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা রয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ শিশু-কিশোরের মাদকসেবনে হাতেখড়ি ঘটে সাধারণত স্কুলে কিংবা পাড়া-মহল্লায় সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবের দিয়ে প্ররোচিত হয়ে। শিশু-কিশোরদের নিয়মিত ধূমপান বা অন্যান্য মাদকসেবন হতে পারে মূলত অনিরাপত্তাবোধ থেকে কিংবা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভের আকাঙক্ষার ফলে। অনেকে মাদকসেবনকে ‘বয়সের দোষ’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। এই বয়সে শিশু-কিশোররা অনেক বেশি বেপরোয়া হয় এবং যেকোনো কাজে তারা পরিণামের কথা চিন্তা না করেই অংশগ্রহণ করে ফেলে।”

কম বয়সে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের পরবর্তী জীবনে মাদকের প্রতি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাদকাসক্ত হওয়ার সঙ্গে বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। কোনো শিশু বা কিশোরের যদি আগে থেকেই বিভিন্ন মানসিক অবস্থা যেমন-ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি প্রভৃতি থাকে, মাদকাসক্তির ফলে সেগুলো আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। অ্যালকোহল কিংবা অন্য কোনো মাদকসেবনের পর অনেক শিশু-কিশোরই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেমন অনেকেই চায় নিজেদের গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোর দক্ষতা অন্যদেরকে দেখাতে। এতে করে রাস্তায় তাদের নিজেদেরতো বটেই, পথচারীদেরও দুর্ঘটনায় প্রাণনাশের কারণ হতে পারে। মাদকাসক্তির ফলে স্বভাবতই শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় মন বসে না, স্মৃতিশক্তিও লোপ পায়। ফলে তাদের অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স নিম্নগামী হতে থাকে। মাদকসেবন একপর্যায়ে মাদকাসক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তা মানুষকে বিভিন্ন শারীরিক অক্ষমতা ও দুর্বলতা, অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়। 

কিশোর-কিশোরীদের মাদকাসক্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে বাবা-মা। অভিভাবকের উদাসীনতার ফলেই তারা শিশু-মাদকাসক্তের শিকার হয়। সন্তান মারমুখী ও আগ্রাসী আচরণ করলে শারীরিক অবয়বের পরিবর্তন বা আকস্মিক স্বাস্থ্যহানি ঘটলে, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলে বা নিজেকে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে গুটিয়ে নিলে, খাওয়া ও ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হলে কিংবা বারবার অদায়িত্বশীল আচরণ করলে, দুর্বল বিচারবুদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে আগ্রহের অভাব দেখা দিলে বোঝা যায়, সে খারাপসঙ্গ বা মাদকাসক্তির শিকার। এক্ষেত্রে শিশু-কিশোররা বারবার পারিবারিক বিধি-নিষেধ অমান্য করে। এমনকি কোনো ধরনের অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও তার ঘরে ওষুধের শিশি বা পাতা দেখা যায়।  

দেশে মাদকের ভয়াবহতা ও ব্যাপ্তি ঠেকাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে। আইনটিতে মাদকের পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তিও নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনে কমপক্ষে দুই বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং মৃত্যুদ-ের বিধানও রয়েছে। তবে মাদকদ্রব্যের পরিমাণ যদি ১০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হয়, সেক্ষেত্রে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-ও হতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইয়াবা, সিসা, কোকেন, হেরোইন ও প্যাথিড্রিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার, সেবন, বহন, আমদানি-রপ্তানি বা বাজারজাত করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ৫ গ্রাম পর্যন্ত কোকেন, হেরোইন, মরফিন ও প্যাথিড্রিন পাওয়া গেলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদ- ও অর্থদ- দেয়া যাবে। এই মাদকের পরিমাণ ৫ থেকে ২৫ গ্রামের মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদ- ও অর্থদ- এবং মাদকের পরিমাণ ২৫ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদ- বা মৃত্যুদ- ও অর্থদ-ের কথা বলা হয়েছে। মাদক নির্মূলে রয়েছে এমন শক্তিশালী আইন। অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা (অপিয়াম উদ্ভূত, তবে হেরোইন ও মরফিন ব্যতীত মাদকদ্রব্য)-এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ২ কেজি হইলে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদ-েরও বিধান রাখা হয়েছে। আর এর পরিমাণ ২ কেজির ঊর্ধ্বে হলে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রয়েছে।

সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে গেলে বাবা-মাকে ধৈর্য্যহারা হওয়া উচিত নয়। বাবা-মা সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। সন্তানের ব্যথা পিতা-মাতাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করে। বিপথগামী সন্তানকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরেয়ে আনতে বাবা-মায়ের বন্ধুসুলভ আচরণ প্রয়োজন। সন্তানের সাথে হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে কথা বলতে হবে। শিশু-কিশোরদের সচেতন করতে বা তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সোজাসুজি, খোলামেলা তাদের সাথে যেকোনো বিষয়ে কথা বলা। শিশু বা কিশোর বয়সী সন্তান মাদকসেবী না হলেও  ভবিষতের চিন্তা করে তার সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। তাকে সিগারেট, অ্যালকোহল ও অন্যান্য নেশাদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে। কেন এগুলো সেবন করা উচিত নয়, তা বস্তাবজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে দরদের সাথে বোঝাতে হবে। পাশাপাশি সন্তান কার সাথে মেশে, কোথায় যায়, কী করে-এ ব্যাপারে সবসময় খবরাখবর নিতে হবে। ছেলে-মেয়ের বন্ধুবান্ধবদের ভালো করে চিনতে হবে। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে তারা সন্তানের জন্য অসৎ সঙ্গ নয়। এছাড়া, পারিবারিক মূল্যবোধের চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যা সন্তানের ভেতরও প্রভাবিত হবে। সুশৃঙ্খল জীবনাচারে অভ্যস্ত করতে হবে। 

পরিবারের জন্য বাধ্যতামূলক পালনীয় কিছু নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ তৈরি করতে হবে এবং সন্তানদের সেসব বিধি-নিষেধের নেপথ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। সন্তান যেন ঠিকমত বিধিনিষেধ মেনে চলতে পারে, সেদিকে সবসময় সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। কোনো কারণে সন্তান মাদকাসক্ত, বিষয়টি প্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা গরম করে তাকে বকাবকি করা যাবে না। তার কোনো কাজে তাৎক্ষণিক বাধা দেয়া ঠিক হবে না। বরং ঠান্ডা মাথায় তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ধৈর্য্য ও সহানুভূতির সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করে শিশুর মানসিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখাই হবে বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যের দায়িত্ব। যদি নিজে নিজে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, খবরাখবর নিয়েও সন্তানকে মাদকের পথ থেকে ফিরিয়ে না আনা যায়, তাহলে অবশ্যই পেশাদার কারো সাহায্য নিতে হবে। সেটি হতে পারে কোনো চিকিৎসক, কাউন্সেলর বা স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ। তাদের পরামর্শ মতো কাজ করলে সন্তানের ভুল পথে পা বাড়ানো রোধ করা সম্ভব। 

পরিশেষে বলা যায়, শিশু-কিশোরদের ভালো বন্ধু হয়ে উঠলে, তার মনের খবর রাখলে, যেকোনো সময় তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সন্তান বিপথে যাবে না। বাবা-মায়ের মানসিক সহায়তা পেলে এবং ব্যক্তি, পারিবার ও সামাজিক জীবন নিয়ে সন্তানের মধ্যে কোনো অনিরাপত্তা বা অনিশ্চয়তাবোধ না থাকলে, তার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে যায়। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকাও এসাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম যদি আরো অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে মাদক নিয়ন্ত্রণের চলমান লড়াইটা আরও সহজ হয়ে যাবে।

লেখক: জোহরা শিউলী, ফ্রিল্যান্স রাইটার, পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।