যমুনার চরে গবাদিপশু পালনে স্বপ্ন বুনছেন লক্ষাধিক পরিবার
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:২৫ অপরাহ্ন, ১০ই ডিসেম্বর ২০২৩
যমুনা হুড়াসাগর নদী বেষ্টিত পাবনার বেড়া উপজেলার চরাঞ্চলের জীবন বৈচিত্র্য পাল্টে যাচ্ছে জেগে ওঠা চরের ছোঁয়ায়। গবাদিপশুর খামার ও কৃষি বদলে দিচ্ছে নদীভাঙা মানুষের জীবন।
এ উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরে দরিদ্র চাষিরা গবাদিপশু এবং কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। একসময় পদ্মা, যমুনা, হুড়াসাগর, ইছামতী নদীগুলো ছিল এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখের কারণ। এখন সেই নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে অভাব দূর করছেন চাষিরা।
আরও পড়ুন: সরিষাবাড়ীতে ৫ শতাধিক গবাদি পশুকে টিকা প্রদান
অক্লান্ত পরিশ্রমে অসম্ভবকে সম্ভব করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন ভূমিহীন নিঃস্ব এক লাখ পরিবার। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের বেলে মাটিতে ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্নের ফসল বুনে ঘরে তুলে লাভবান হচ্ছেন চরাঞ্চলের নিঃস্ব খেটে খাওয়া মানুষ। পদ্মা, যমুনা,হুড়াসাগর, ইছামতী অসংখ্য চরের বেলে-দোআঁশ মাটিতে এখন শাকসবজি সহ নানা প্রকার ফসল ফলছে। সেই সাথে গড়ে উঠছে গবাদিপশুর খামার। কৃষি ও গবাদিপশুর খামার পাল্টে দিচ্ছে চরের মানুষের জীবনযাপন।
ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড নিয়ার ইস্টের (ইসপান) প্রণীত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের প্রধান পাঁচটি নদীতে চরের আয়তন প্রায় এক হাজার ৭২২ দশমিক ৮৯ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের মোট জমির এক দশমিক ১৬ শতাংশ। এই পরিমাণ চরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চরভূমি রয়েছে উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায়। এ চরের পরিমাণ ৯৮৭ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটার।
পদ্মা অববাহিকায় চরভূমি ৫০৮ দশমিক ২৭ বর্গকিলোমিটার। মেঘনার উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় চরের পরিমাণ ২২৬ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। এ চর এলাকায় বাস করছে অন্তত সাত লাখ মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে যমুনা নদীর চর এলাকায়।পদ্মা ও যমুনার বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় চরে গড়ে উঠছে জনবসতি ও গবাদিপশুর ছোট ও মাঝারি খামার। চরগুলোর দূরত্ব ১৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার।
সর্বনাশা পদ্মা যমুনা সহ শাখা নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে ভূমিহীন নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। এমনকি অভাব-অনটন ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এখন সে চিত্র বদলে গেছে। কয়েক বছর আগে যেখানে ছিল বালুচর, সেই চর বন্যায় পলিমাটি জমে এখন উর্বর আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে।
দিগন্ত বিস্তৃত বালুচরে এখন আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন রকমের ফসল। নদীর তলদেশ শুকিয়ে জেগে ওঠা পরিত্যক্ত বালুচরে ফসল ফলানো তো দূরের কথা, ঘাসও জন্মাতো না। অথচ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেই নদীর ছোট-বড় অসংখ্য চরে ফলছে গম, কাউন, ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, গাজর, মরিচ, হলুদ, শসা, সিম, কুমড়াসহ নানা প্রকারের ফসল।
চরের বেলে দোআঁশ মাটিতে ডাল জাতীয় ফসল মাষকলাই, খেসারি, ছোলা প্রচুর পরিমাণে আবাদ হচ্ছে। চরে কৃষি বিপ্লবের পাশাপাশি গবাদিপশুর খামার গড়ে ওঠায় সম্ভাবনাময় পদ্মা, যমুনা, হুড়াসাগর নদীর বুকে জেগে ওঠা এসব চর পাল্টে দিতে পারে অর্থনীতির চিত্র।
চরে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই রয়েছে গরু-মহিষ-ছাগলের ছোট ছোট খামার। বিপুল সম্ভাবনাময় চরাঞ্চলে গবাদিপশু পালনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করলে সম্ভাবনাটি বাস্তবে রূপ নেবে বলে মনে করে সচেতন মহল।
আরও পড়ুন: কোরবানির জন্য প্রস্তুত ১ লাখ ৫১ হাজার ৬২২ গবাদিপশু
উপজেলার হাটুরিয়া - নাকালিয়া ইউনিয়নের চর নাগদাহ গ্রামের কৃষক ও স্থানীয় ইউপি সদস্য জাহিদ মোল্লা বলেন, চর এলাকার জমি সোনার চেয়েও দামি।এসব জমিতে এক চাষেই তিনবার ফসল ফলানো সম্ভব। অগ্রাহায়ন , পৌষে বাদাম চাষ করা হয়,তাঁর উপর আমনধান এবং মাষকলাই ছিটানোর পরে পর্যায়ক্রমে একসাথে তিন প্রকার ফসল পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ বাদামের পরিবর্তে তিল চাষ করে থাকেন।
উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলের কৃষক ও খামারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চর এলাকার খোলামেলা পরিবেশে গবাদিপশু পালন করায় রোগবালাই কম হয়। পলি মাটির আস্তরনে জেগে ওঠা ঘাস, বিচালি খাইয়ে অনেকেই গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার ছোট ছোট খামার গড়ে তুলছেন।চরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি করে গো-খামার গড়ে উঠছে। গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা তাদের গবাদিপশু নিয়ে এসেছে চরে।
যমুনা ও পদ্মা শাখা নদীগুলোর পেটে জেগে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় চরের বালিয়াড়িগুলো ক্রমেই আবাদি জমিতে পরিণত হচ্ছে। একদিন পদ্মা-যমুনা ও প্রমত্তা শাখা নদীগুলোতে যেসব গ্রাম বিলীন হয়ে গিয়েছিল সেগুলো পুনরায় সেই নামেই নতুন করে গড়ে তুলছে বসতি। অভাবী শত শত পরিবারের নারীরা তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে সেই ফসল বিক্রি করে সফলতা পাচ্ছেন। চর সাঁড়াশিয়া গ্রামের কৃষক সাত্তার বেপারি জানান, বালুচরে কোনো ফসল ফলানো যাবে এটা স্বপ্নেও ভাবিনি, এখন বালুচরে ফসল আবাদ করে অভাবের সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। প্রতি বছর চরের পরিধি বাড়ায় স্বাবলম্বী হচ্ছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।
সরেজমিন উপজেলার চর নাগদাহ, চরসাঁড়াশিয়া, হাটাইল, আড়ালিয়া, চর নাকালিয়া, চর পেচাকোলা, চর পাইখন্দ গিয়ে দেখা যায়, প্রায় বাড়িতেই রয়েছে গরুর ও মহিষের খামার। চরের প্রতিটি গ্রামেই দেখা মেলে দুধ ব্যবসায়ী ও দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির। তারা চরম ব্যস্ততায় প্রতিটি বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে বিশেষ ধরণের পাত্র বোঝাই করে ঘাটে ভিরানো নৌকায় পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন।
চরসাঁড়াশিয়া গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল জানান, তিনি সকাল ও বিকাল মিলিয়ে প্রতিদিন চর থেকে কমপক্ষে ২৫ মণ দুধ সংগ্রহ করেন। সেগুলো দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ ও ব্র্যাকের (আড়ং দুধ) শীতলীকরণ কেন্দ্রে সরবরাহ করেন। তিনি আরো জানান, তার মতো কমপক্ষে ২৫ জন দুগ্ধ ব্যবসায়ী এভাবে প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করে বিভিন্ন দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন।
আরএক্স/