শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১:১৮ পূর্বাহ্ন, ১৪ই ডিসেম্বর ২০২৩


শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা
বিষ্ণু প্রিয় দীপ। ফাইল ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বিষাদ ও বেদনার দিন। ১৯৭১ সালে জাতির চির গৌরবের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি হানাদার বর্বর সেনাবাহিনী। এই হত্যাযজ্ঞে সরাসরি সহায়তা করছিল তাদের পদলেহী এই দেশের কতিপয় কুলাঙ্গার-রাজাকার,আলবধর,আলশামস নামে যারা ঘৃণিত ও ধিক্কৃত। 


দেশের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বিত্রমের সামনে টিকতে না পেরে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার সেনারা যখন মাথানত করে আত্নসমর্পণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তার অব্যবহিত আগে তারা এক জঘন্য নিল নকশা করেছিল।বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল পরিকল্পিত। কেবল ১৪ ডিসেম্বর নয় মাসের শুরু থেকে বিজয়ের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। আমি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।


আরও পড়ুন: শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান


শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: বাংলাদেশে পালিত একটি বিশেষ দিবস। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।


সংজ্ঞা: ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’দের সংজ্ঞা চুড়ান্ত করা হয়। সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারী ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙ্গালি সাহিত্যিক, দার্শনিক ,বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক ,প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাষ্কর, সরকারী ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গেছেন তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী।


দিবস ঘোষনা: ১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরিকল্পিত ভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধান মন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহম্দে এই দিনকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষনা করেন’।


 দেশে যে সকল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে তাদের জীবনী আমি অবগত নই। তবে আমার বাবা রবীন্দ্র চন্দ শীলের নিকট থেকে বাল্যকালেই শুনেছি আমাদের পাকুটিয়ায় সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী প্যারী মোহন আদিত্যকে হানাদারা হত্যা করেছে। ১৯৩৪ সালে ৫ জুন প্যারী মোহন আদিত্য সাবেক টাঙ্গাইল মহকুমার বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবা মোকন্দ মোহন আদিত্য, মা মহামায়া আদিত্য। চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য ছিলেন দ্বিতীয়। ঠাকুর  অনুকুল চন্দ্র পুরুষোত্তম প্রথাগত শিক্ষা ও আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার কুফল সম্পর্কে সদা সচেতন ছিলেন। তিনি জীবনমুখী বাস্তব বিদ্যা ও অধ্যত্ববিদ্যার একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের অন্যতম শিষ্য প্যারী মোহন আদিত্য। তিনি তার বাবাকে সহযোগীতায় কাজের পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা, গান, নাটক, আবৃত্তি, সমাজসেবা, যাত্রা পালা ও পত্রিকা সম্পাদনায় অধিক মনোযোগী ছিলেন। ‘সৎসঙ্গ’পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। পাশাপশি এলাকার বিভিন্ন সাস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। অল্প দিনেই প্যারী মোহন আদিত্য এলাকার সভার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়ে ওঠেন।


আরও পড়ুন: শহিদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্যের প্রয়াণ দিবস


পাকুটিয়ার সৎসঙ্গ আশ্রমের ওপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কয়েরবার ভয়াবহ আক্রমন পরিচালিত হয়। সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রাস্তার দ্ইু ধারে অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে পরপর শেল আঘাত করে মন্দিরের শীর্ষ চুড়া গুঁড়িয়ে দেয়। অল্পের জন্য প্যারী মোহন আদিত্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পরিবার সহ বেঁচে যান। আবার সেবা ধর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক মাস পরই ১৯৭১ সালের ২১ মে আবার পাকিস্তানী ও তাদের দোসররা অতর্কিত হামলা চালায় পাকুটিয়া বাজার ও পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সাঁড়াশি  অভিযান চালায়। গ্রেপ্তার হন প্যারী মোহন আদিত্য। তাকে থানা সদর ঘাটাইল ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। অবর্ণনীয় নিযার্তন চলে তার ওপর। কোনো এক ভাবে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।


অবশেষে আসে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের জীবনে ভয়াবহ কালো দিন। ১৯৭১ সালের ৮ আগষ্ট সৎসঙ্গ আশ্রম আবার আক্রান্ত হয়। মুহুমুহু গুলি চলতে থাকে। প্যারী মোহন আদিত্য পালানোর সুযোগও পান না। পাকিস্তানি বাহিনী তার তলপেটে গুলি চালায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চালানো হয় বেয়নেট ও ছুরিকাঘাত।  সে অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জিজ্ঞেস করতে থাকে নরপশুর দল। দেশ প্রেমীক প্যারী মোহন আদিত্য নির্বাক থেকে নিযাতিত হতে হতে দেশের তরে জীবন উৎসর্গ করেন। পরে বড় ভাই তৎকালীন সৎসঙ্গ সম্পাদক রাসবিহারী আদিত্য ও আশেপাশের লোকজন গোপনে বাড়ির পাশে বাবা ও মায়ের সমাধির পাশে শেষকৃত  সম্পন্ন  করেন। শহীদ জায়া বীণা রাণী আদিত্য স্বামী শোকে  কোথায় যেন হারিয়ে যান, তার আর খোজ পাওয়া যায় নি। তাদের সন্তান নটো কিশোর আদিত্য পরে জ্যাঠা এবং বড়মা অর্থাৎ জ্যাঠিমার কাছে বড় হয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য স্মরণে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। এ লেখার মাধ্যমে তার সমাধি স্থলে একটি বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি করছি।


আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক যে দেউলিয়াত্বের জন্ম হয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। যারা মুত্তবুদ্ধির মানুষ ছিলেন, যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারতেন, তাদেরই চিহিৃত করে হত্যা করা হয়েছে। এই ট্র্যাজিডি বাংলার ভাষা ও ভাবনাকেও রক্তাক্ত করেছে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ ৫২ বছরে স্বাধীনতার পূর্তি হবে। স্বাধনিতার ৫২ বছরে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেখানো পথে প্রিয় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। ধর্ম-বর্ণ- শ্রেণি নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালি এই সা ভূখন্ডে কাঁদে কাধ মিলিয়ে বসবাস করতে হবে। তা হলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। 


আরএক্স/