আমাদের বঙ্গবন্ধু


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


আমাদের বঙ্গবন্ধু

শত বছরের বাঙালি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এই সংগ্রামে সেরা হয়ে জড়িয়ে আছে। তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বের অন্যতম নেতা ও বাঙালির জাতির পিতা। গভীর অত্যাচারের পর তিনি এসব অমীয় বিশেষণ লাভ করেছেন। ইতিহাসের কাব্যে কবিরা তাকে নিয়ে লিখেছেন “যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা, যমুনা গৌরী বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের সংসারে আশার আলো হয়ে জন্মলাভ করেন । তার জন্ম তারিখ ছিল ১৭ মার্চ । গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় শেখ আউয়াল নামের এক ধার্মিক পুরুষের প্রতিষ্ঠিত বংশ পরিক্রমায় “শেখ” পরিবার।  

শেখ মুজিবুর রহমান শিশুবেলা থেকেই ছিলেন পাখিপ্রেমী ও অত্যন্ত মাধুর্যময় বালক। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ভালোবাসার খোকা ও অন্যদের মিঞাভাই। শৈশবে পুকুরে সাঁতার ও এক গাছ থেকে অন্য গাছে ঝাঁপ দেওয়া ছিল তার প্রতিদিনের কাজ। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছোটবেলা থেকেই তিনি অংশগ্রহণ করতেন।  ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবেও এলাকায় পারদর্শিতা ও খ্যাতি ছিল তার। এই বিষয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিপিবদ্ধ করেছেন, “পুরো বছরই আমি ও আমার দল আব্বার অফিসার্স ক্লাবের সাথে খেলতাম।”

বাঙালি জাতির পিতার কখনো জাত-ধর্ম ভেদে মানুষকে পার্থক্য করার চেষ্টা করতেন না। মানুষ হিসেবে তিনি সবাইকে সমান নজরে দেখতেন। এই মহৎ গুণের কারণে তিনি সর্বদা বাঙালির প্রিয় নেতা হয়ে স্মরণীয় থাকবেন। নিজ বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রথম কারাবরণ করেন তিনি, তাই বলা যায় তিনি অত্যন্ত বন্ধুত্বপরায়ণ। সকল মানুষের আপদে-বিপদে একজন বন্ধুর মতো কাজ করতেন ।

শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়েও দেশ ও বাঙালির সেবা করে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন সে অত্যন্ত সাদাসিধে সরল হৃদয়ের মানুষ। জনগণের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সকলের মুখে হাসি ফুটিয়ে তিনি বাংলার কিংবদন্তি ও প্রিয় নেতা হতে পেরেছে ।

খোকা থেকেই অসাধারণ মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু । কর্তব্যরোধ, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মানবিক গুণাবলী বঙ্গবন্ধুকে উঁচু স্থানে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে । তিনি অত্যন্ত কতর্ব্যপরায়ণ ও দায়িত্ববান ছিলেন । প্রতিটি কাজ নিষ্ঠার সাথে সঠিকভাবে পালন করতেন। অসাধারণ কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্বের দায়িত্বকে সমন্বয় করে তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন । এভাবেই তিনি দুরন্ত কিশোর থেকে বাঙালি জাতির পিতা ও আমাদের বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন ।

প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে গিমাডাঙ্গা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাজীবনের শুরু । মাধ্যমিকে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনের এক পর্যায়ে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে একটি বিশেষ আলোচনা করে খন্দকার শামসুদ্দিনকে সভাপতি ও নিজেকে সম্পাদক করে ছাত্রসংগঠন হিসেবে গোপালগঞ্জ মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন।পরবর্তীতে মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটি গঠন হয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেখানেও সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত হয়।

বঙ্গবন্ধু সর্বদা অন্যের উপকার করার চিন্তায় চির উদ্যমী ছিলেন। কীভাবে এই জাতীর উপকার করা যায় কিভাবে প্রতিটি বাঙালিকে সাহায্য করা যায় সারাজীবন এই ভাবনার সূত্রে কাজ করে যান। ফুটবল দলের নেতৃত্ব থেকে বাঙালির নেতা প্রতিটি পদক্ষেপ তার ছিল সাজানো গোছানো ।

বর্তমান সমাজ যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করছে সেভাবে বঙ্গবন্ধু তার পিতার আদর্শকে সর্বদা শ্রদ্ধা করতেন । বুকভরা সাহস নিয়ে তিনি কখনোই পিছনে ফিরে যাননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার । অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৯ পৃষ্ঠায় সূত্রপ্রমাণে তিনি বলেছেন “ হতেই পারেনা। সে দলের মধ্যে কোঠারি করে তাঁরে পদ দেওয়া যাবেনা।”

রাজনৈতিক কার্য ও গণতন্ত্র পন্থায় তিনি প্রখর আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সর্বদা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বুদ্ধি ও জ্ঞান এবং নিজের আত্মমর্যাদার উপর আস্থা রাখতেন। তিনি শিক্ষকদের নিকট অত্যন্ত স্নেহের  একজন ছাত্র ছিলেন। অনেকের নয়নের মণি । কোন অন্যায় আবদার না করায় শিক্ষকদের কাছে তার ভালোবাসা ছিল অসীম।

ইসলামীয়া কলেজ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি পর বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ সংগ্রামী জীবন শুরু হয় । ১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ও তার সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম নেয় । কমিটি গঠনের পর পরই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে অধিষ্ঠিত হন।

বায়ান্নোতে শুরু হয় আন্দোলন। তাতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে শহীদ হন। ১৯৫৪ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচনে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয়ী করে প্রমাণ করেন তিনিই শ্রেষ্ঠ বাঙালি । তিনি ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে বাঙালির মুক্তির সনদের ইতিহাস করে বাঙালির মনে প্রেরণার চিহ্ন হিসেবে নিহিত হন। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ঘড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ মোট ৩৫ জনের নামে মামলা হলেও জনগণের বিক্ষোভের মুখে সরকার বঙ্গবন্ধুসহ সকলকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়।

১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।  ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় অর্জনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে । যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে মানুষ সর্বদায় আওয়ামী লীগের উপর আস্থা রাখেছেন।

১৯৭১ সালে শুরু হলো যুদ্ধ । বাঙালি জাতির পিতার নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা অপরিসীম । বলা যায় বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু এগুলো যেন সমার্থক শব্দ। বঙ্গবন্ধু রেসর্কোস ময়দানে প্রায় দশ লক্ষ লোকের সমাগমে বলে উঠেন “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম । কিছুদিনপর বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। দীর্ঘ নয়মাস এই সংগ্রাহ শেষে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি পায় বাঙালি জাতি। আকাশে বাতাসে উড়ে সোনার বাংলার বিজয় পতাকা।

পরবর্তীবছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সেই স্মরণে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে প্রতিবছর পালন করা হচ্ছে।  দেশে ফিরে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে পুনঃগঠন করার চেষ্টা করেন । যাতে শুরু হয় নতুন সংগ্রাম । ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য সংবিধান উপহার দেন, যা দেশ উন্নয়নে আজও দায়িত্ব পালন করে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সক্রিয় রাখতে তিনি তৎপর ভূমিকা পালনের আদেশ প্রদান করেন। তিনি সর্বদা স্বপ্ন দেখতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সুন্দর বাংলাদেশ। তাই তিনি অর্থনৈতিক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ শুরু করেন। অনেক মানুষের কর্মের ব্যবস্থাও করেন যা সকলের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল ।
 
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ । তার শাসনকালে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনঃগঠন হয় । বাঙালি হিসেবে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ প্রদান করে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ও নেতা। তিনি বাঙালিকে যে আদর্শের নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছে, তা বাঙালি অনুসরণ করলে বাংলাদেশ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠতে বেশি দিন সময় লাগবে না। তিনি তার দূরদর্শী ও সঠিক নেতৃত্বের কারণে বাঙালির মনে চিরকাল স্মরণে থাকবে।

লেখক: রানা আহম্মেদ অভি শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ।

এসএ/