গ্রাহকের ২০০ কোটি টাকা হাতানো চক্র গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
গ্রাহকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতাসহ পাঁচ জনকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করার দাবি করেছে র্যাব। বিনিয়োগে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতাসহ পাঁচ জনকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করার দাবি করেছে র্যাব।
শনিবার (১২ মার্চ) রাতে অভিযান চালিয়ে নরসিংদী থেকে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান। এ বিষয়ে আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানায় র্যাব।
র্যাব বলছে, সম্প্রতি সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ প্রতারণার ঘটনা প্রচারে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য ও আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন।
র্যাব জানিয়েছে, নরসিংদীর প্রায় সব থানার পাঁচ-ছয় হাজার সাধারণ পেশাজীবী মানুষ একটি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে ব্যবসায়ে অতিরিক্ত লভ্যাংশ প্রাওয়ার আশায় শত শত কোটি টাকা অর্থ বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের সারা জীবনের কষ্টার্জিত জমানো অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
র্যাব জানায়, প্রতারক চক্রের সদস্যেরা সাধারণ মানুষের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। একদিকে, করোনা মহামারিতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, অপরদিকে, বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে পথে বসেছে চক্রটির খপ্পরে পরা নরসিংদীর সর্বস্তরের শত শত মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী জনগণ তাদের গচ্ছিত টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় স্থানীয় সমবায় অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করে। যার ফলশ্রুতিতে জেলা সমবায় অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু, প্রতারকেরা লাপাত্তা হয়ে যায়।
র্যাব বলছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় গুটিয়ে নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নরসিংদী জেলায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পত্রিকাসহ জাতীয় প্রিন্ট ও ইকেট্রনিক মিডিয়ায় তা বহুলপ্রচারিত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ ব্যাপক প্রচার চলতে থাকে। ঘটনাটি সারা দেশে প্রচারিত হলে নরসিংদীর সর্বস্তরের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে নরসিংদী জেলার পলাশ থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে লিখিত অভিযোগ গ্রহণ শেষে বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে নরসিংদীর পলাশ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদপ্তরেও অভিযোগ করেন। সংঘটিত ঘটনায় ভুক্তভোগীরা আইনি সহযোগিতার প্রত্যাশায় লিখিত অভিযোগ নরসিংদীতে র্যাব-১১-এর কার্যালয়ে এসে জমা দেন। এরপর র্যাব ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
র্যাব জানায়, এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১-এর অভিযানে গতকাল শনিবার রাতে নরসিংদীর সদর থানাধীন ভেলানগর এলাকায় গোপন বৈঠক চলাকালীন উপর্যুক্ত প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতা মো. শাহ আলম (৫০) এবং তাঁর চার সহযোগী—মো. দেলোয়ার হোসেন শিকদার (৫২), কাজী মানে উল্লাহ (৪৪), মো. সুমন মোল্লাহ (৩৩) এবং আবদুল হান্নান মোল্লাহকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব জানায়, ২০১০ সালে নরসিংদীর সদর থানাধীন চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় একটি শরিয়াভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানির প্রধান কার্যালয় বসায় একটি প্রতারক চক্র। প্রতারকচক্রটি কৌশলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদমুক্ত ব্যবসায় প্রলুব্ধ করে বিভিন্ন পেশাজীবীর কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ জনগণকে ভুল বুঝিয়ে তাদের সংস্থার সদস্য করা হত। সুদমুক্ত জীবনযাপন ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানের লোক দেখানো মূল প্রতিপাদ্য। ওই চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম নিজে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে চারটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং ২৪ জনের সমন্বয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন এবং অতিরিক্ত ২০ জনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। আত্মীয় বা পরিচিতদের তাঁরা পরিচালক এবং পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিতেন।
পরবর্তীকালে প্রতারকচক্র নরসিংদীর বিভিন্ন থানার জনবহুল ও ব্যবসায়িক এলাকায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হল শাহ সুলতান এম. সি. এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি., স্বদেশ টেক্সটাইল লি., শাহ সুলতান টেক্সটাইল লি. ও শাহ সুলতান প্রপার্টিজ লি.।
র্যাব বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, মাঠপর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রতারকচক্রের তিন শতাধিক কর্মী রয়েছে, যাঁদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। এসব কর্মীকে গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে এককালীন ১০ শতাংশ এবং বছরান্তে ৬ শতাংশ অর্থপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হতো। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক ১২-১৬ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখাতেন। এ ছাড়া তাঁরা গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চ মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে ডিপিএস-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতেন বলে জানায়। এভাবে তাঁরা গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হন। তাঁরা বেশ কিছু গ্রাহককে উচ্চ মুনাফায় ঋণ দেন। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও প্রতারক চক্র ব্যাংকের মতোই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ ল্যান্ড প্রজেক্ট টেক্সটাইলসহ নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করে এ চক্র। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে বলে জানান। তবে, গ্রাহকদের তথ্য অনুযায়ী সংগৃহীত টাকার পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলে র্যাব জানিয়েছে।
র্যাব জানায়, করোনার ক্রান্তিলগ্নে যখন মানুষের টাকার প্রয়োজন হয়, তখন ভুক্তভোগীরা তাঁদের আমানতের টাকা শাহ সুলতান এম. সি. এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.-এর নিকট উত্তোলনের আবেদন করেন। তখনই প্রতিষ্ঠানটি করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন অজুহাতে গচ্ছিত টাকা ফেরত না দিতে গড়িমসি শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক এবং ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাসুদ রানা গ্রাহকদের লগ্নি করা টাকা দিয়ে নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে পাঁচ-ছয় একর জমি নিজেদের নামে ক্রয় করেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নামে নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে সাত-আট একর জমি রয়েছে বলে জানা যায়। টাকা ফেরতের জন্য গ্রাহকদের ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠানটিতে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেপ্তার করা আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
এসএ/