পাক হানাদারের ব্রাশফায়ারে পন্ডিত পরিবারের ১৪ জন শহীদ হয়
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪:৩৬ অপরাহ্ন, ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২৪
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৬ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার চণ্ডিপুর গ্রামে পন্ডিত পরিবার থেকেই পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নারী-পুরুষ ও এক দিনের শিশুসহ ১৪ জন শহীদ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় আরও ৪ জন।
মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার সূত্রে জানাযায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে কুষ্টিয়া জেলা ১৭ দিন পাকহানাদার মুক্ত থাকে।
কুষ্টিয়া জেলা শহর পতনের ফলে তা পুনরায় দখলের জন্য পাকবাহিনী যেনো মরিয়া হয়ে ওঠে। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পাকশী পাড়ে জড়ো হতে থাকে। প্রতিরোধ করতে এপার ভেড়ামারায় বাঙ্গালী ইপিআর, পুলিশ, আনসার, যুবক ও কিশোরের সমন্বিত একদল স্বাধীনতাকামী মানুষ অবস্থান নেয়।
সামান্য গুটিকয় মেশিনগান, এলএমজি, ৩০৩ রাইফেল ও কিছু চাইনিজ রাইফেল নিয়ে শক্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
প্রতিরোধ বাহিনীকে সহযোগীতার জন্য এপারের ষোলদাগ, বাহিরচর , ফারাকপুর, চাঁদগ্রাম , চন্ডিপুর, বাড়াদি গ্রাম হতে শত শত কৃষক সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ বিভিন্ন ভাবে সহোযোগিতা করে। সেসময় নারীরাও খাদ্য সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে।
১৫ই এপ্রিল প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। আধুনিক অস্ত্রের মুখে সামান্য গোলবারুদ নিয়ে টিকতে না পেরে প্রতিরোধ বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ফ্রন্ট ছেড়ে পিছনের দিকে ভেড়ামারার পশ্চিমে আর একটি শক্ত ফ্রণ্ট তৈরীর জন্য পশ্চাৎসরন করতে থাকে। পাক হানাদার বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পার হয়ে ভেড়ামারায় উপস্থিত হয়।
প্রতিরোধ বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ফ্রন্ট ছেড়ে পশ্চাৎসরনকালীন সময়ে এলাকার জনসাধারনের উপর পাক হানাদার বাহিনীর অজানা পৈচাশিক হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কায় নিরীহ জনসাধারণকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে বলে। পন্ডিত পরিবার বাদে ভেড়ামারা ও আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন নিরাপদ দুরত্বে চলে যায় ।
পন্ডিত পরিবার সূত্রে জানাগেছে, ভেড়ামারার চন্ডিপুরে ফতেহ আলী পন্ডিত পরিবারের বসবাস। ফতেহ আলী পন্ডিত ব্রিটিশ আমলে শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সফিউদ্দীন তাঁর দশম শ্রেণি পড়ুয়া ভাইপো সদরুল ইসলামকে নিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের যুদ্ধে যোগদান করেন।
গ্রামের অধিকাংশ লোকজন নিরাপদে চলে গেলেও পরিবারের দুইজন সদস্য যুদ্ধে থাকায় তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন পন্ডিত পরিবার।
এছাড়াও পন্ডিত বাড়ীর মহিলাদের একজন সন্তান সম্ভবা হওয়ায় দ্যোদুল্যমান ভাবনায় বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হয়।
১৫ই এপ্রিল সন্ধ্যায় নিরাপদ দুরত্বে চলে যাওয়ার জন্য জিকে ক্যানেল ও রেললাইন পার হয়ে পশ্চিমে চন্দনা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় চন্দনা নদী পার হতে না পেরে পরদিন অর্থাৎ ১৬ই এপ্রিল সকালে নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এমন সময় সংবাদ আসে পাক হানাদার বাহিনী এগিয়ে আসছে।
এদিকে ফতেহ আলী পন্ডিতের কন্যা ও মীর জালালের স্ত্রী অন্তঃসত্তা সাজেদা বেগমের প্রসব বেদনা উঠে।
এ অবস্থায় চন্ডিপুরের চন্দনা নদীর পাড়ে অনীল সরকারের বাড়ীর পাশে একটি ঝোপের আড়ালে বড় একটি গর্তে সবাই আশ্রয় নেয়। ভোরের দিকে পাক আর্মিরা আসছে কিনা তা দেখতে সাইকেলে আক্তারুজ্জামান বাবলু (১৮) দেখতে যায়। পাক আর্মিরা বাবলুকে দেখে ফেলে পিছু নেয়। এক পর্যায়ে ঝোপঝাড় তলাশী করে গর্তের কাছে এসে হাজির হয়।
খুঁজে পেয়ে পাক হানাদার বাহিনী সয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্রাস ফায়ার চালায়। মুহুর্তের মধ্যে ১৪টি তাজা প্রাণ মৃত্যূর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে হানাদার বাহিনী চলে যায়।
পন্ডিত বাড়ীর ওই দলে ২০ থেকে ২২ জন ছিলো। এর মধ্যে ১৪ জন শহীদ ও ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। বাকীরা লাশের নিচে চাপা পড়ে বেঁচে যায়।
ব্রাশ ফায়ারে নিহত সবাইকে পন্ডিত পরিবারের সদস্যরা অনীল সরকারের জমিতে ব্রাশফায়ার স্থলেই কোন রকম গর্ত খুড়ে ১৪ শহীদের গণকবর দিয়ে রাখে।
পরে দেশ স্বাধীন হলে ১৪ শহীদের গণকবরটি ওই স্থান থেকে তুলে এনে পন্ডিত পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।
গণহত্যায় শহীদরা হলেন, শহীদ শফিউদ্দিন (৫২), শহীদ শফিউদ্দিনের ছেলে শহীদ মশিউর রহমান(১৮), শহীদ মীর রাবেয়া খাতুন(৪৫),শহীদ মীর ডায়মন্ড(১৯), শহীদ মীর আক্তারজ্জামান (২২), শহীদ মীর নুতন, (০৮) শহীদ মিস নীলা(১৪), শহীদ জালালউদ্দিন(৫৪), শহীদ মীর সহিদা আহমেদ রুবী ( ২২), শহীদ মীর নবীণ(০১ দিন) শহীদ জাহেদা খাতুন(৩৮), শহীদ সেলিনা খাতুন(১৬) শহীদ ফাতেমা খাতুন (৩৪), শহীদ ছদরল ইসলাম (২২)।
আহত হলেন মোছা: সাজেদা বেগম (৪২), মোছা: আফরোজা বেগম, (৭),
মোছা: জাহানারা বেগম মায়া (০৮),মো: আমির খসরু(০৪)
শহীদদের মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধে সামরিক প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত পন্ডিত বাড়ীর ৪ সদস্য ছিলেন।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে জাতীর জনক ব্ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পন্ডিত পরিবারের সকল শহীদের জন্য নিজের স্বাক্ষরিত শোক বার্তা প্রদাণ করেন এবং প্রত্যেক নিহত পরিবারকে দুই হাজার টাকার চেক প্রদান করেন।
শহীদ পরিবারের গুলিবিদ্ধ সদস্য আমীর খসরু বলেন, দেশ স্বাধীন হলে ১০ মাস পর গণকবরটি ওই স্থান থেকে তুলে এনে পন্ডিত পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে ১৪ শহীদের মরদেহের দাফন করা হয়। দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল গণকবরটি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃষ্টপোষকতায় গতবছর চন্ডিপুর গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ।
ভবিষ্যতে এ স্মৃতিসৌধ এ দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিবে এ জাতির স্বাধীনতার জন্য তার পূর্ব পুরুষেরা কিভাবে অকাতরে জীবন দিয়ে গেছেন।
আরএক্স/