গ্রামীণ অর্থনীতিতে খামারিদের নীরব বিপ্লব
মো. রুবেল হোসেন
প্রকাশ: ০৫:২৮ অপরাহ্ন, ১৮ই মার্চ ২০২৪
দিন যত যাবে খামার বড় হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে খামার করা এবং সহজ বিপণ এখন নিজের হাতেই। খামারি হিসেবে যত ছোটই হইনা কেন, আমরা খামারি আমাদের সেই পরিচয় আছে। নিজেদের নামে আছে ব্যাংক একাউন্ট হাঁস, মুরগি,গরু-ছাগলের রোগ বালাই নিয়ে কোন সমস্যাই পড়লে আমরা পিজি সদস্যরা বসে (প্রডিউসার গ্রুপ) বৈঠক করি।
খামারের প্রাণীদের জন্য হেলথ কার্ড রয়েছে। ফলে এসব প্রাণীর স্বাস্থ্য সেবায় আর বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা নেই। ছোট ছোট খামারিরা গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে (এলডিডিপি) প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের জীবন বদলানোর কথা জানান দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ভুক্তভোগী খামারিরা।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে দেশব্যাপী প্রডিউসার গ্রুপ চালু করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রাণিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো, মার্কেট লিংকেজ ও ভ্যালু চেইন সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারীদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে এই প্রকল্প।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প যাত্রা শুরু করার পর করোনা মহামারিতে পরের দেশ। ফলে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজে বেশ ব্যাঘাত ঘটে। তারপরও কাজের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় চলমান এই প্রকল্পটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন মান ও অর্থনীতিতে সাফল্য ঘটাবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামীণ বিপ্লব অব্যাহত থাকবে ধারণা করছেন অনেকেই।
দুগ্ধ উৎপাদনকারী দলের প্রডিউসার গ্রুপ (পিজি) সদস্য মোছা. আসমা আক্তার বলেন, আমি অনেক দিন যাবত খামার করেছি কিন্তু আগে কোন সুযোগ সুবিধা পেতামনা, তেমন কোন লাভ হতোনা। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এখন লাভবান হচ্ছি। আগে গরু অসুস্থ হলে গরু গুলোকে চিকিৎসার জন্য অনে দূরে নিয়ে যেতে হতো। এখন ফোন দিলেই ডাক্তার আসে যার ফলে গরুর চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। আমার খামারে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভ্যাকসিন দিতেও সমস্যা হয়না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার পিজি সদস্য লুৎফর রহমান বলেন, পিজি সদস্য হয়ে আমি জানতে পারি অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া কিভাবে মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। করোনা কালীন সময়ে ১৫ হজার টাকা প্রণোদনা পেয়েছি। খামারের মুরগির কোন সমস্যা হলে ফোন দিলে ডাক্তার পেয়ে যায়।
আরও পড়ুন: বেগুন চাষে স্বাবলম্বী ভাঙ্গার সম্রাট মাতব্বর
ক্যাম্পাস নার্সারিতে উন্নতমানের ঘাস উৎপাদন করে অধিক আয়ের কথা জানান কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পিজি গ্রুপের সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, অনেক বছর যাবত আমি গরুর খামার করেছি তবে আমার প্রতি বছর ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার অতিরিক্ত খর ক্রয় করতে হতো। পিজি সদস্য হয়ে এলডিডিপি'র আওতায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাটিং সংগ্রহ করি। এখন আর খর ক্রয় করতে হয়না।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে পাওয়া ক্রিম সেপারেটর মেশিন ব্যবহারকারী ডেইরি খামারি মো. আনিসুর রহমান বলেন, আমি একজন খামারি। খামারে উৎপাদিত দুধ থেকে মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করে বিক্রি করি। যা বিক্রয় করে অল্পকিছু মুনাফা পেতাম। প্রকল্পের সহোযোগিতায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর আমাকে একটি ক্রিম সেপারেটর মেশিন দেন। এই মেশিনের সাহায্যে ক্রিম আলাদা করে ঘি ও মাখন উৎপাদন করি। ঘি ও মাখন বিক্রয় করে আমি বেশি মুনাফা অর্জন করছি।
করোনা কালীন সময়ে দুধ ডিম মাংস বিক্রিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। তখন এই পিজিই তাদের সব সমস্যার সমাধান করেছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে তাদের জন্য ২৪ ঘন্টার মনিটরিং সেল গঠন করে। মাঠ পর্যায় থেকে তাদের উৎপাদিত সব জিনিস নিয়ে আসতো এবং তাদের আয় একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি। এ সময় উপজেলা ও ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা লাইভস্টক অফিসাররা মাঠ পর্যায় থেকে দুধ, ডিম,মাংস সংগ্রহ করেন।
আরও পড়ুন: সোনালী হলুদ রঙের মুকুলে ভরে গেছে আমের বাগান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার লাইভস্টক অফিসার ডা. নূরে আলম বলেন, প্রাণিসম্পদ ও ডেইলি উন্নয়ন প্রকল্পের সহোযোগিতায় নাসিরনগর উপজেলায় খামারিদের তালিকা করেছি। যাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এন্টিবায়োটিক ছাড়া কিভাবে বয়লার মুরগী লালন পালন করা যায় এবং কিছু লেয়ার খামারি আছে তাদেরকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছি।এন্টিবায়োটিক ছাড়া মাংস উৎপাদন প্রমোট করার চেষ্টা করছি। খামারিরা তাদের মুরগিগুলোকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ খামারে প্রয়োগ করেনা।
তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষণের আলোকে নিরাপদ মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে যে সকল খামারিরা মুরগি লালনপালন করবে তাদেরকে সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করছি। প্রকল্পের আওতায় খামারিদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্প্রে মেশিন প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও প্রসেসিং প্লান্ট কিভাবে তৈরি করতে হয় সেটা নিয়ে কাজ করছি। নাসিরনগর পোল্ট্রি শিল্পের মডেল হিসেবে তৈরি হবে। মানুষের নিরাপদ পোল্ট্রি, মাংস ও ডিম খাওয়া নিশ্চিত করতে কাজ করছি।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা লাইভস্টক এক্সটেনশন অফিসার ডা. শর্মিষ্ঠ ভট্টাচার্য বলেন, ত্রিশালে মোট ১২টি পিজি গঠন হয়েছে এর মধ্যে একটি ভেড়া পিজি রয়েছে। ভেড়া পিজির সদস্য ২৩ জন। সকল সদস্যদের একটি করে ঘর দেওয়া হয়েছে। মুক্তভাবে ভেড়া পালন করে খামারিদের অনেক সমস্যার মধ্যে পরতে হতো। অনেক সময় ভেড়া গুলোকে কুকুরে কামুড় দিত। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের ভেড়া পিজির ঘর পেয়ে খামারিদের সেই সমস্যায় আর পরতে হয়না এর ফেলে ভেড়ার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অনেক সময় ভেড়া চুরি হয়ে যায়। নিরাপদ ঘর পাওয়ার কারণে এখন আর ভেড়া চুরি হবেনা পাশাপাশি গবাদিপশুর কোন রোগ হলে খামারিরা চিকিৎসা পাচ্ছেন।
জেবি/এসবি