সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ-এর শক্তি আসলে কতটা?
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫:০৪ অপরাহ্ন, ৭ই এপ্রিল ২০২৪
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতির ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় আসা সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থেকেই সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়ে এলিট ফোর্স র্যাব বলেছে সে অভিযানে ‘পাহাড়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল’ প্রয়োগ করা হবে।
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে যে তারা মনে করছে থানচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার ঘিরে দুটি ব্যাংকের শাখায় হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানারই দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে থাকতে পারে।
তবে বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) গভীর রাতে আলীকদম উপজেলায় যে গোলাগুলির খবর এসেছে সেটি কোনো চেকপোস্টে হামলার ঘটনা ছিল না বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
২০২২ সালে পার্বত্য এলাকায় ‘জঙ্গি বিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালিয়েছিলো নিরাপত্তা বাহিনী। তখন কেএনএফের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি সংগঠন’ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছিলো। ওই অভিযানের পর কেএনএফ এর সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না।
এদিকে, মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে থানচি বাজারে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলার ঘটনার পর শুক্রবার (৫ এপ্রিল) অনেক মানুষকেই থানচি ছাড়তে দেখা গেছে। রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে কেএনএফের দুই সদস্য গ্রেফতার
তবে থানচি গিয়ে চট্টগ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার মানুষজনকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এখন যে পরিস্থিতি আছে তা সামাল দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের আছে। ওদিকে ব্যাংকে হামলা, কর্মকর্তা অপহরণ ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় শুক্রবার মোট ছয়টি মামলা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। রুমা ও থানচিতে হামলার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ওই ঘটনার জন্য কেএনএফকে অভিযুক্ত করেছেন। তবে কেএনএফ এর দিক থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি।
কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘বিছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবেই বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেছেন তাদের ধারণা থানচিতে হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানার দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে।
“পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পারছি তাতে আমাদের মনে হয় আশেপাশের পাহাড়েই তারা আছে। তবে তাদের এমন কোনো শক্তি নেই যে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে। একটা পরিস্থিতি হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরও হুট করে ব্যাংকে হামলা করে টাকা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে কেএনএফ এর শক্তি আসলে কতটা এবং তারা কোনো ধরনের আঞ্চলিক আশীর্বাদ পাচ্ছে কি না।
বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন তারা মনে করেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুইটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। “প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করা”। কিন্তু এই সক্ষমতা বলতে কেএনএফের শক্তি বা সামর্থ্যের কথা বোঝানো হলে এই প্রশ্নও আসে যে প্রকৃত অর্থে কতটা শক্তিশালী এই কেএনএফ।
গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবানের শান্তি আলোচনা বিষয়ে কেএনএফ এর বিভিন্ন সূত্রের সাথে যাদের যোগাযোগ হয়েছিলো তাদের কয়েকজন ধারণা দিয়েছেন যে কেএনএফ এর সামরিক শাখার সদস্য সংখ্যা সাড়ে তিনশ থেকে চারশোর মতো হতে পারে।
আরও পড়ুন: অভিযানে ২ অস্ত্র উদ্ধার, কয়েকজন সন্ত্রাসী আটক: সেনাপ্রধান
একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে শুরু করা কেএনএফ ২০২২ সালের শেষ দিকে বেশ সক্রিয় ছিল ফেসবুকে। তখন ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিলো। তারও আগে তারা ফেসবুকে জানিয়েছিলো যে তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে যার নাম – হেড হান্টার কমান্ডো টিম।
ওই বছরের জুলাই মাসে ফেসবুকে কেএনএফ জানায়, তাদেরে একদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর অগাস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে তাদের কমান্ডো।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলামের। মি. ইসলাম বলছেন কেএনএফের শক্তি ও সমর্থন খুব একটা আছে তেমনটা তিনি মনে করেন না।
“তবে আমার মনে হয় তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় তারা একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরে জঙ্গি ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে এসেছে। আবার কেএনএফ আলোচনায় আসায় হয়তো আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগেই এবারের ঘটনা ঘটেছে”।
আরও পড়ুন: জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ২৩ নাবিকের মুক্তি নিয়ে সুখবর
তবে কেউ কেউ আবার মনে করেন বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে আলোচনায় আসার কারণে কেএনএফ-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও এবারের হামলার একটি কারণ হতে পারে।
“বিছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে এটা দেখা যায় বিশ্বজুড়েই। মূল নেতৃত্ব সরকারের সাথে আলোচনায় যেতে চাইলে পরবর্তী ধাপ বা অন্য স্তর থেকে আঘাত আসে। তারা হয়তো ভাবে সমঝোতা হয়ে গেলে তাদের আর অর্জন কী থাকলো,” বলছিলেন মি. ইসলাম। তার মতে রুমা ও থানচির ঘটনায় সেটিও একটি কারণ হতে পারে।
বান্দরবানের শান্তি আলোচনার সাথে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে তাদের ধারণা এই শান্তি আলোচনাকে ঘিরে কেএনএফ এর সামরিক ও রাজনৈতিক শাখার মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে। তবে এরও কোনো প্রমাণ নেই।
পার্বত্য জেলায় অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে ইউপিডিএফ, জেএসএস ও জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)সহ বেশকিছু আঞ্চলিক সংগঠন বিভিন্ন কায়দায় সন্ত্রাসী কর্মকন্ড, চাঁদাবাজী, অস্ত্রবাজী করে যাচ্ছে। তাদের নির্মূল করার দরকার বলে দাবি করেন সচেতন মহল।
এমএল/