তাপপ্রবাহে উপকূলে লবণচাষীদের মুখে প্রাপ্তির হাসি
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:০৯ অপরাহ্ন, ১২ই মে ২০২৪
দেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। উপকূলীয় পর্যটন জেলা কক্সবাজারও প্রকৃতির এমন বিরূপতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। বৃষ্টি কামনা করে ইসতিশতার নামাজও আদায় করছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ। সবমিলিয়ে এক দুর্বিষহ সময় কাটছে দেশবাসীর।
অপরদিকে প্রচণ্ড রোদ আশীর্বাদ হয়ে এসেছে লবণচাষীদের জন্য। চলমান তাপপ্রবাহে তাদের মুখে প্রাপ্তির হাসি। পরিবারগুলোতে যেন খুশির আমেজ। লবণচাষীদের ভাষ্যমতে, রোদের তীব্রতা যত বেশি বাড়বে, লবণ উৎপাদন তত বাড়বে।
কক্সবাজারের টেকনাফে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিঘার পর বিঘা জমিতে তপ্ত রোদে চিকচিক করছে সাদা সোনাখ্যাত লবণ। সাদা রঙের ওপর ঠিকরে পড়া সূর্যের প্রখর আলোয় চোখ ঝলসে যায়। বিভ্রম জাগে দৃষ্টিতে। কোনো কোনো মাঠে নোনাপানিতে ঠিকরে পড়ছে গ্রীষ্মের কড়া রোদ। আবার কোনো মাঠে পলিথিনের ওপর লবণ ফুটে আছে।
কড়া রোদে পুড়ে প্রবল উৎসাহ নিয়ে কাজ করে চলেছেন লবণচাষীরা। কেউ মাঠ প্রস্তুত করছেন, কেউ মাঠে নোনাপানি তুলছেন। মাঠের লবণ জড়ো করে লাই ও বস্তায় ভরে গাড়ি কিংবা ট্রলারে তুলছেন কেউ। অনেকেই মাঠে গর্ত করে লবণ ঢুকিয়ে রাখছেন। কেউ লবণ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি অথবা গুদামে।
টেকনাফ সাবরাং নয়াপাড়ার হাকিম আলী ও জয়নুল আবেদীন দু’জন লবণচাষী। বললেন, ‘আমরা নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে লবণ তুলতে পারি নাই। মার্চ ও এপ্রিল মাসে কড়া রোদ থাকায় লবণ তুলতে পারতেছি। তীব্র গরম লবণ উৎপাদনের জন্য আশীর্বাদ।
‘আবহাওয়ার চলমান পরিস্থিতি আর কিছুদিন এমন থাকলে এ বছর সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হবে। বাজারে এই মুহূর্তে লবণের দাম কম। তবে বৃষ্টি নামলে দাম ভালো পাওয়া যাবে। এই রোদ আমাদের জন্য আশীর্বাদ।’
সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে সাগরের নোনা পানির জমিয়ে তা শুকিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় লবণ উৎপাদন করা হয়। একসময় সনাতন পদ্ধতিতে চাষ হলেও এখন মাঠে পলিথিন বিছিয়ে লবণ চাষ হচ্ছে।
টেকনাফে এক হাজার ৯৭৫ জন চাষী লবণ উৎপাদনে জড়িত। সাবরাং, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, হ্নীলা, জাদিমুড়া, রঙ্গীখালী, হোয়াইক্যং- এসব জায়গায় লবণের চাষ হয়।
আরও পড়ুন: ৬৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদনের রেকর্ড
চলতি মৌসুমে এখানে এক কানি জমি লবণ উৎপাদন হয়েছে ৩৭৭ মণ। ২০২৩-২০২৪ লবণ মৌসুম শুরু হয়েছে গত বছরের ১২ নভেম্বর। বর্তমান সময় পর্যন্ত লবণ উৎপাদন এক লাখ ৭০ হাজার ৬০ টন।
বেসিক টেকনাফ লবণ কেন্দ্রের প্রধান মিজানুর রহমান জানান, তীব্র তাপপ্রবাহের সুবাদে গতকাল (রবিবার) এখানে এক হাজার টন করে লবণ উৎপাদন হয়েছে। মাঝেমধ্যে উৎপাদনের এই পরিমাণ দিনপ্রতি এক হাজার টনও ছাড়িয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবহাওয়া একটি বড় বিষয়। এবার টানা অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড রোদে লবণের উৎপাদন হয়েছে ব্যাপক। গত ৬২ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে এ বছর লবণ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত এক লাখ ৭০ হাজার ৬০ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। আরও ১৫-২০ দিন আবহাওয়া এমন থাকলে লবণে উৎপাদনে বড় ধরনের রেকর্ড তৈরি হবে।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দেয়া তথ্যমতে, চলতি মৌসুমের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ লাখ ১০ হাজার ৯১৮ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। অথচ গত বছর পুরো মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ টন। চলমান তাপপ্রবাহ আরও কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে লবণ উৎপাদন ৩০ লাখ টন হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
টেকনাফ সাবরাং শাহপরীর দ্বীপ এলাকার লবণচাষী মো. জামাল বলেন, ‘তীব্র গরমে লবণের উৎপাদন অস্বাভাবিক বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণের উৎপাদন অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় আমরা খুশি। তবে গত বছরের চেয়ে এবার লবণের দাম মণপ্রতি ১০০ টাকার বেশি কমেছে।
টেকনাফ সাবরাং লবণচাষী কল্যাণ ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফিক মিয়া বলেন, ‘বর্তমানে মাঠে প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন হচ্ছে। মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়াগত কারণে চাষীরা লবণ উৎপাদন করতে পারেনি। সে সময় লবণের ভালো দাম পেলেও এখন দাম একটু কমের দিকে।
আরও পড়ুন: লবণাক্ত যায়গায় কলা চাষ করে তাক লাগিয়েছেন ইয়াকুব খান
‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে লবণ আমদানির প্রয়োজন হবে না। গত বছর প্রতি মণ লবণের দাম ছিল ৪২০ টাকা। বর্তমানে প্রতিমণ লবণের মূল্য ৩১০ টাকা। আরও কিছুদিন তাপদাহ থাকলে লবণের উৎপাদন দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে।’
লবণ ব্যবসায়ী মো. শরীফ মেম্বার বলেন, ‘মাঠে এখন প্রচুর পরিমাণ লবণ পড়ে আছে। বৃষ্টি কিংবা কালবৈশাখী ঝড়ে এসব লবণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাঠের গর্তে কিংবা গুদাম বা মিল পর্যায়ে লবণ মজুত করে রাখা হচ্ছে। এখন দাম কম থাকার কারণে মজুত করা হচ্ছে। একটু ভালো দাম পাওয়ার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে।’
জেবি/এসবি