যক্ষা হলে রক্ষা নেই, এই কথার ভিত্তি নেই
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
যক্ষ্মা Mycobacterium tuberculosis নামের জীবাণুঘটিত দীর্ঘস্থায়ী এক সংক্রামক ব্যাধি। এ রোগ TB নামেও পরিচিত। যক্ষ্মা একটি প্রাচীন রোগ। পঞ্চম শতকের প্রথম দিক থেকেই এটি মারাত্মক রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যক্ষ্মা জীবাণুর বিভিন্ন জাত গৃহপালিত পশু ও বন্যপ্রাণীদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটায়। এ রোগ সচরাচর ফুসফুসের ক্ষতি করে, কিন্তু শ্বাসতন্ত্র, অস্থি ও অস্থিসন্ধি, ত্বক, লসিকাগ্রন্থি, অন্ত্র, কিডনি এবং স্নায়ুতন্ত্রও আক্রমণ করে। শ্বাসগ্রহণের সময় জীবাণু ফুসফুসে প্রবেশ করলেই সাধারণত সংক্রমণ ঘটে।
দূষিত খাদ্যগ্রহণেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। যক্ষ্মাগ্রস্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি থেকে নির্গত কফ বা থুথুর কণাগুলো অন্যের শরীরে ও বাতাসে জীবাণু ছড়ায়। এসব জীবাণু বাতাসে, শুষ্ক কফ ও থুথুতে এবং ধূলাবালিতে দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকে। রোগটি অন্যদের তুলনায় একই পরিবারের লোকদের মধ্যে অধিক পরিমাণে সংক্রমিত হয়ে থাকে, কেননা এক পরিবারের সদস্যরা একই বাড়িতে বসবাস করে, একই টেবিলে খাবার খায় ও পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে। তবে যক্ষ্মা বংশানুক্রমিক রোগ নয়।
বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা মহামারী এবং রোগ নির্মূল করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য প্রতি বছর ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করা হয়। ২০১৮ সালে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ টিবিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয় এবং ১.৫ মিলিয়ন লোক এই রোগে মারা যায় যার বেশিরভাগই নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে। ২৪ মার্চ ১৮৮২ সালের সেই দিনটিতে বিজ্ঞানী রবার্ট কোচ বার্লিনের ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি ছোট দল নিয়ে যক্ষ্মা রোগের কারণ, টিবি ব্যাসিলাস আবিষ্কার করেছেন ঘোষণা করে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে চমকে দিয়েছিলেন।
যক্ষ্মা শব্দটা এসেছে "রাজক্ষয়" থেকে। ক্ষয় বলার কারণ এতে রোগীরা খুব শীর্ণ বা রোগা হয়ে পড়েন। যক্ষ্মা প্রায় যেকোনও অঙ্গে হতে পারে ব্যতিক্রম কেবল হৃৎপিন্ড, অগ্ন্যাশয়, ঐচ্ছিক পেশী ও থাইরয়েড গ্রন্থি। যক্ষ্মা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফুসফুসে। গরুর দুধ পাস্তুরায়ণ প্রচলনের আগে অন্ত্রেও অনেক বেশি হত। টিকা বা ভ্যাকসিনেশনের মধ্যে দিয়ে যক্ষ্মা প্রতিরোধ করা যায়। ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে হাল্কা জ্বর ও কাশি হতে পারে। কাশির সঙ্গে গলার ভিতর থেকে থুতুতে রক্তও বেরোতে পারে। মুখ না ঢেকে কাশলে যক্ষ্মা সংক্রমণিত থুতুর ফোঁটা বাতাসে ছড়ায়। আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর বদ্ধ পরিবেশে মাইকোব্যাক্টেরিয়াম অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট হিসেবে ৫-৬ মাস জ্বর থাকার মূল কারণ এই টিবি।
সাধারনত তিন সপ্তাহের বেশি কাশি, জ্বও, কাশির সাথে কফ এবং মাঝে মাঝে রক্ত বের হওয়া, ওজন কমে যাওয়া, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা ও ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি ফুসফুসের যক্ষার প্রধান উপসর্গ। এই রোগের সর্বাধিক প্রচলিত ও পরিচিত ধরনটি হলো ফুসফুসীয় যক্ষ্মা। শুরুতে ফুসফুসীয় যক্ষ্মার উপসর্গগুলি প্রকাশিত নাও হতে পারে। সক্রিয় অথবা প্রাথমিক অবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে ফুসফুসীয় যক্ষ্মায় কাশি, দুর্বলতা, ওজনহ্রাস, কফ ও থুথুর সাথে সামান্য রক্তপাত, ফুসফুসের স্থানসহ বুকব্যথা এবং জ্বর যা দিনের বেলায় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি উপসর্গ প্রকাশ পায়। অধিক সংখ্যায় জীবাণু শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিস্তারের ফলে মিলিয়ারি যক্ষ্মা দেখা দেয়। এ জাতীয় যক্ষ্মায় মস্তিষ্কের আবরনী আক্রান্ত হলে মেনিনজাইটিস যক্ষ্মা নামক মারাত্মক রোগের প্রকোপ ঘটে।
যক্ষা ফুসফুস থেকে অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশেষ করে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তখন একে অ-শ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষা বলা হয়, যেমন পন্ডুরাতে পন্ডুরিসি, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে মেনিনজাইটিস, লসিকাতন্ত্রে স্ক্রফুলা, প্রজনন তন্ত্রে প্রজনন তন্ত্রীয় যক্ষা, পরিপাক তন্ত্রে পরিপাক তন্ত্রীয় যক্ষা এবং অস্থিকলায় পট'স ডিজিস। অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুসীয় এবং অ-ফুসফুসীয় যক্ষা একসাথে বিদ্যমান থাকতে পারে। বিশ্বে যক্ষ্মা রোগীদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ভারতীয় উপমহাদেশবাসী। জীবাণু শরীরে ঢুকলেই সবার যক্ষ্মা হয় না। যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মা বেশি হয়।
যক্ষ্মা দুনিয়াজোড়া অন্যতম প্রধান ঘাতক ব্যাধি হয়ে আছে। এখনও এটি অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। একাধিক ঔষধ প্রতিরোধক্ষম জীবাণু উৎপত্তির আগে ১৯৯০ সালের দিকে যক্ষ্মা যথেষ্টই হ্রাস পেয়েছিল। গৃহহীন, উদ্বাস্তু ও জেলখানার কয়েদিদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অধিক। গত শতকে কেবল যক্ষ্মা রোগেই ২০ কোটির বেশি লোক মারা গেছে। বর্তমানে যক্ষ্মা বিস্তারের হার হলো প্রতি সেকেন্ডে ১ জন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে দৈনিক প্রায় ২০০০ লোকের মৃত্যু।
১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরী সহায়তায় বিশ্ব ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রম (ঘঞচ) শুরু হয় এবং প্রায় ৩ লক্ষ ১৩ হাজার ৮০০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়। এদের ৮০ শতাংশেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসার সাহায্যে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এই সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগের পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক, কেননা দেশে রয়েছে অত্যধিক জন ঘনত্ব, নিম্নমানের আবাসন, দারিদ্র ও শিক্ষার নিম্ন হার।
১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে বিসিজি টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে এই অঞ্চলে যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে পুরোনো ঢাকার নীমতলিতে একটি যক্ষ্মা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সংগঠিত যক্ষ্মা চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে বিভাগীয় সদরে আরও ৩টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জেলাসদরের হাসপাতাল, ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রম ক্লিনিক, চাঁনখারপুল এলাকায় যক্ষ্মা নিরাময় ও নিয়ন্ত্রন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও মহাখালীর জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রমের সদর দপ্তরে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে।
১৯৬৪-১৯৬৬ সালে সর্বপ্রথম জাতীয় পর্যায়ে যক্ষ্মারোগের উপর অনুষ্ঠিত জরিপ থেকে জানা যায় যে জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% যক্ষ্মার সাধারণ ধরন, প্রধানত শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত ফুসফুসীয় যক্ষায় কমবেশি আক্রান্ত। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যক্ষ্মা একটি ‘বিশ্ব সংকট’ হিসেবে ঘোষিত হওয়ায় অত্যধিক যক্ষ্মাক্রান্ত অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যক্ষ্মারোগ বিস্তার রোধে Directly Observed Treatment/DOTS- Short Course নামে সাধারণ্যে পরিচিত ঔষধের তদারকমূলক হস্তক্ষেপের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটি একটি সাশ্রয়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রমের অধীনে ১৯৯৩-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্যারামেডিকসহ ৩০ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে যক্ষ্মা শনাক্ত ও রোগনির্ণয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্র্যাক, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন, ডেনিশ-বালাদেশ লেপ্রসি মিশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রংপুর দিনাজপুর রুরাল সার্ভিসেস, ন্যাশনাল অ্যান্টিটিবি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থা সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। কার্যকর উপদেশমূলক সতর্কতার উপর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এই কর্মসূচিতে ব্যক্তিগত চিকিৎসক, উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ সফল যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য।
কিছু বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যেমন: ১। জন্মের পর পর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দেয়া, ২। হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করা, ৩। যেখানে সেখানে থুথু না ফেলা, ৪। রোগীর কফ থুথু নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলা। যখন কোন এ্যান্টিবায়োটিক যক্ষ্মা রোগের সকল জীবাণু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয় তখনই ঔষধ প্রতিরোধক যক্ষার সূত্রপাত হয়। এর মূল কারণগুলো হলো : পর্যাপ্ত চিকিৎসা গ্রহণ না করা, ভুল ঔষধ ও সেবন চিকিৎসার কোর্স সম্পূর্ণ না করা। যক্ষার লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
বাংলাদেশের সকল- উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জেলা সদর হাসপাতাল বক্ষব্যাধি ক্লিনিক/হাসপাতাল, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এনজিও ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সমূহে বিনামূল্যে কফ পরীক্ষা, রোগ নির্ণয়সহ যক্ষার চিকিৎসা করা হয় ও ঔষধ দেয়া হয়। পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলেও অনেক সময় যক্ষার সংক্রমণ হতে পারে। যেমন : যক্ষার সংক্রমণের ৮-১০ সপ্তাহ পরে তা ত্বকের পরীক্ষায় ধরা পড়ে। তার আগে পরীক্ষা করলে ধরা নাও পড়তে পারে। এইডস এর মতো কোন রোগের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে অনেকসময় পরীক্ষায় যক্ষা রোগ ধরা পড়ে না।
এছাড়া এইডস এবং যক্ষা রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো প্রায় এক রকম হওয়ায় এইডস রোগীদের যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি জটিল হয়ে থাকে। হামের টিকা নিলে এগুলোতে অনেক সময় জীবন্ত জীবাণু থাকে, এর জন্য ত্বক পরীক্ষায় যক্ষা ধরা নাও পড়তে পারে। শরীরে যক্ষা রোগের জীবাণু বেশি মাত্রায় ছেয়ে গেলে ত্বকের পরীক্ষায় রোগের জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে। অনেক সময় সঠিকভাবে পরীক্ষা না করলেও এতে যক্ষা রোগের জীবাণু ধরা পড়ে না। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগের ধরন, মাত্রা এবং রুগীর বয়স অনুসারে ঔষধের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। যক্ষার চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে: এন্টিবায়োটিক সেবন। সাধারণত ৬-৯ মাস ব্যাপী এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করতে হবে।
লেখক: মো: আরাফাত রহমান, কলামিস্ট, সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়