ডিপিডিসি’র কোম্পানি সচিবের ঘুষ দাবি
ভুয়া ট্রাস্কফোর্সের আড়ালে প্রকৌশলী জাহাঙ্গীরের চাঁদাবাজি!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১১ অপরাহ্ন, ৩রা জুলাই ২০২৪

চাকরি জীবনে যেখানেই স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, সেখানেই দুর্নীতির রামরাজত্ব কায়েম করেছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম (আইডি নং- ১১৩০২)। গ্রাহককে হয়রানি করা থেকে ভুয়া টাস্কফোর্সের মাধ্যমে দুর্নীতি, কি করেন না তিনি! তার অবৈধ কাজে কেউ বাঁধা হয়ে দাড়ালেই তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, উল্টো তাকে ষড়যন্ত্রে ফেলেন। বিভিন্ন সময়ে তদন্তে দুর্নীতির প্রমান মিললেও কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাচ্ছেন ডিপিডিসির এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
ডিপিডিসির সূত্র বলছে, ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম বংশাল ও বাংলাবাজার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন, তখন তিনি বংশাল এলাকার এক বিদ্যুৎ গ্রাহকের বাসায় ভুয়া ট্রার্স্কফোর্স পরিচালনা করে ঐ গ্রাহক বিদ্যুৎ চুরি করছে এই অভিযোগ এনে গ্রাহককে ভুয়া প্যানেল বিল জারি করে। পরবর্তীতে গ্রাহক আবুলকে চাপ প্রয়োগ করে তার কাছ থেকে নগদ পাঁচ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করেন প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর।
সংস্থাটির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ডিপিডিসি কোম্পানীর সচিব দপ্তরের ট্রাস্কফোর্স গোপনে সংবাদ পায় বংশাল ডিভিশন এলাকায় এক গ্রাহকের বাসায় বাইপাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। তাৎক্ষনিক ট্রাস্কফোর্স ঐ বাড়িতে অভিযান চালালে ট্রাস্কফোর্সের সদস্যদের চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যায়। ট্রাস্কফোর্সের সদস্যদের ঐ বাড়ির মালিক আবুল বলেছেন, মাত্র ৪/৫ দিন আগেই তো আপনারা আমার বাসায় অভিযান চালালেন, আবার এখন কেন এসেছেন আমার বাড়িতে? একটা মুরগিকে কতবার জবাই দিবেন বলে প্রশ্ন ছুড়ে দেন বাড়ির মালিক। সেদিনইতো আপনাদের নগদ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দিলাম। আবার কেন এসেছেন? আমিতো এখন আর বাইপাস ব্যবহার করি না। বাড়ির মালিকের এই অভিযোগ শুনে ট্রাস্কফোর্স সদস্যরা হতভম্ভ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ঐ ট্রাস্কফোর্স সদস্যরা মুঠোফোনে তৎকালীন কোম্পানীর সচিবকে বিষয়টি অবহিত করলে কোম্পানী সচিব ট্রাস্কফোর্স সদস্যদের অফিসে ফিরিয়ে আনেন। কোম্পানীর সচিব দপ্তরের সূত্র জানায়, তারা আসার সময় ঐ বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভুয়া প্যানেল বিল জারির কপি এবং ভুয়া ট্রাস্কফোর্স সদস্যদের মোবাইল নাম্বারগুলো নিয়ে আসে। পরবর্তীতে কোম্পানীর সচিব দপ্তর প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে ঐ নাম্বারগুলো তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং বংশাল ডিভিশনের দুইজন বিদ্যুৎ কর্মীর।
পরবর্তীতে বিষয়টি কোম্পানী সচিব তৎকালীন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানকে অবহিত করলে তাৎক্ষনিক কোম্পানীর সচিবকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। ঐ দিন ডিপিডিসির তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী তারিকুল হক (উন্নয়ন) নেতৃত্বে তিন সদস্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি ঘটনা তদন্ত করে প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং তৎকালীন বংশাল ডিভিশনের দুই বিদ্যুৎ কর্মীকেও দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ঐ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সম্প্রতি বর্তমান সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বংশাল ডিভিশনের দুই বিদ্যুৎ কর্মীকে চাকুরিচ্যুত করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এবং তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) জাহাঙ্গীর আলমকে চলতি বছর গত ১২ জুন কৈফত তলবের নোটিশ দেয়া হয়।
সংস্থাটির এইচআর সূত্রে আরও জানা যায়, ঐ তদন্ত প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীর আলমকে সরাসরি দায়ী করলেও বিশেষ কারনে তাকে চাকুরীচ্যুত না করে কৈফয়ত তলব করার সিদ্ধান্ত হয়। গত ১৯ জুন ঐ কৈফয়ত তলবের জবাব দিয়েছে বলে এইচআর সূত্র জানায়, এদিকে জাহাঙ্গীর আলম এই প্রতিবেদককে মুঠোফোনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, এই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো ভাবে সংশ্লিষ্টতা নেই। ডিপিডিসির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে মিথ্যা ভাবে জড়িয়েছে।
অফিস আদেশ বলা হয়, ২০১৭- এর ৭.৭ বিধি অনুসারে অসদাচরণের দায়ে ডিপিডিসি লাইনম্যান মো. আবুল হোসেনকে (আইডি নম্বর-১৪৪৭৮) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যার স্মারক নম্বর- ২৭.৮৭.০০০০.৪০৫.২৭.০২৩.২০.১৪৫। গত বছরের ২৫ এপ্রিল দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলায় চাকরি বিধি অনুসারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন, লিখিত জবানবন্দি, এই বিষয়ের আনুষঙ্গিক রেকর্ড-পত্র, অভিযোগের ধরণ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায় প্রধান প্রকৌশলীর জাহাঙ্গীরের নির্দেশনায় অবৈধভাবে ৫ লাখ টাকা আদায় করার সতত্যা রয়েছে। ঐ দুই বিদ্যুৎ কর্মীর চাকরি হারালেও বহাল তরিয়াতে প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর। গত ৩০ মে ডিপিডিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (এইচ আর) নূর কামরুন নাহার সাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানা গেছে। ডিপিডিসি’র একটি সূত্র জানায়, প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে প্রধান কার্যালয়ে কয়েকবার গ্রাহকদের অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারনে ডিপিডিসির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এইচআর বিভাগের একটি সুত্র জানান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান মানবিক কারণে তাকে বার বার ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্য কোনো কিছু নয়।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো.জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে দৈনিক জনবানীকে বলেন, আমি নির্দোশ। আমার বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের একটি চক্র উঠে পড়ে লেগেছে। তিনি আরো বলেন, ডিপিডিসির সাবেক কোম্পানি সচিব মো.আসাদুজ্জামান আমার কাছে দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। আমি টাকা দিতে পারলে কোনো সমস্যাই হতো না। কর্মজীবনের শেষ পর্যায় এসে এখন দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিতে হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানি সচিব দপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী(এসডি) রিয়াজ পদন্নতি পেতেই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। আমাকে ফাঁসাতে পারলেই সে পদন্নতি পাবেন। এ বিষয় এসডি রিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে ডিপিডিসির সাবেক কোম্পানি সচিব ও বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মো.আসাদুজ্জামান দৈনিক জনবাণীকে মুঠোফোনে বলেন, আমাকে টাকা দিয়েছে তিনি(জাহাঙ্গীর) প্রমান করতে পারবেন। তিনি নির্দোষ প্রমান করলেই তো পারেন। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তা ছাড়া এই ঘটনায় দুইজন বিদ্যুৎ কর্মীও চাকরি হারিয়েছে। তাদের জবানবন্দীতে প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম এর নাম এসেছে। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমান করলে আর কোনো সমস্যা নাই। তিনি আরো বলেন, জাহাঙ্গীর সাহেবের পদন্নতি জন্য আমি কত কি না করেছি। এখন নিজেকে রক্ষা করতে সে আমার বিরুদ্ধে উল্টোপাল্টা কথা বলছে। এই ভাবে প্রমান ছাড়া আমার বিরুদ্ধে তা বলা ঠিক হচ্ছে না।
এদিকে মক্কায় হজ্ব পালনে অবস্থানরত ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তায় জানান, বিষয়টি আমার ঘোচরে আছে। জাহাঙ্গীরের কৈফয়তের জবাব আমি এখনও দেখিনি। তদন্ত কমিটির বক্তব্য যাচাই করে নিয়ম অনুযায়ী কঠোর পদক্ষেপ নিবো।
এদিকে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক(অপারেশন)শফিকুল ইসলাম দৈনিক জনবানীকে মুঠোফোনে বলেন, আমি ডিপিডিসিতে যোগাদান করেছি অল্পদিন হয়েছে। তাই বিষয়টি অবগত নই। যদি এই ঘটনার সঙ্গে কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র বলছে, এই কর্মকর্তার দুর্নীতির নেটওয়ার্ক বিস্তার লাভ করেছে গভীর শেকড়। গ্রাহকদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতাই শুধু নয়, গ্রাহকরা ঘুষ না দিলে গ্রাহকদের নানা ভাবে হয়রানী করে টাকা আদায়, গ্রাহকদের নয়-ছয় বুঝিয়ে বাড়তি টাকা নেয়া এবং গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার নৃত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটির ব্যবস্থপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান নতুন দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতিমুক্ত একটি স্মার্ট ডিপিডিসি গঠনের প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন এই সিন্ডিকেট। ডিপিডিসির মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছে প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির পরিচালক(প্রকৌশল) মোরশেদ আলম খান মুঠোফোনে বলেন, আমি এই বিষয় কথা বলতে পারবো না। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলুন।
এদিকে মানবসম্পদ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা মুঠোফোনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই জাতীয় ঘটনা ডিপিডিসিতে নতুন নয়। কোন একটা ঘটনা ধরা পরলেই তখন তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি যদি সঠিকভাবে প্রতিবেদনও দেয় তখন সংস্থার প্রধানরা বিশেষ কারনে কঠোর ব্যবস্থা নেয় না। এতে করে সংস্থাটিতে দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। যে কারনে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত দুর্নীতির অষ্টপিষ্টে বেঁধে গেছে। তিনি আরও বলেন, প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম এর বিষয়ে এর ব্যতিক্রম হবে না।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ও ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (উন্নয়ন)তারিকুল হক দৈনিক জনবাণীকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত করা হয়েছে। তাতে যদি কেউ দোষী প্রমান হয়, সেই ক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। আমি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমার কাছ শেষ।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির বাংলাবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী অভিজিৎ সাহা দৈনিক জনবাণীকে বলেন, আমি তখন বংশাল ডিভিশনের দায়িত্বে ছিলাম। গ্রাহকের অভিযোগর পরেই সত্য ঘটনা বেড়িয়ে আসে। ঘটনার পরই ডিপিডিসির কোম্পানী সচিব দপ্তরকে জানালে তারা একটি টিম গিয়ে এর প্রমান পেয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপিডিসির এক সহকারী প্রকৌশলী বলেন, ভুয়া ট্রাস্কফোর্স পরিচালনার নামে জাহাঙ্গীর স্যার এই গ্রহকের কাছে ১৫ লাখ টাকা বিল ধরিয়ে দেন। তার পর নগদ ৫ লাখ টাকা বিল ধরিয়ে দেন।
জেবি/এসবি