প্রকৌশলী হাদীর স্ত্রী নিয়ে বিদেশ বিলাস


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৬:২৫ অপরাহ্ন, ১৬ই জুলাই ২০২৪


প্রকৌশলী হাদীর স্ত্রী নিয়ে বিদেশ বিলাস
ছবি: জনবাণী

বিদেশ ভ্রমণ করাই যেন তার নেশা। ২০১২ সাল থেকে গত নয় বছরে বিশ্বের ১২টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গী করে গেছেন বেশির ভাগ দেশে। সরকারি পঞ্চম গ্রেডের একজন কর্মকর্তার নিজ খরচে এই বিদেশ ভ্রমণের অর্থের উৎস নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ডিপিডিসির এইচআর বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে তিনি বিদেশ প্রমান করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় এর সত্যতাও।


তিনি হলেন ঢাকা পাওয়ার ড্রিস্টিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদী (আইডি ১১০৯০)।


সম্প্রতি এ বিষয় দুদকে একটি অভিযোগ পত্র দাখিল হয়েছে বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালের ৭ জুলাই ডিপিডিসি’র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পান হাদী। চাকরিতে যোগদানের পর থেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্রহক হয়রানী করে কালো টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। ঘুষের টাকায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দেশ। হাদীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকেন তিনি। চলতি মাসে আনন্দ ভ্রমনের জন্য স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে থাইল্যান্ড ঘুরে বেড়িয়েছেন। 


এদিকে রাজিবুল হাদী ২০১২ সালের ৬ এপ্রিল ভিজিট ভিসায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিজি ০০৮৮ ফ্লাইটযোগে ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন এবং ১০ এপ্রিল একই এয়ারলাইনসের বিজি ০৮৬ দিল্লি হয়ে দেশে ফেরেন। ২০১৫ সালে ২৮ জুলাই ভিজিট ভিসায় ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ৭৮৭ একটি বিশেষ ফ্লাইটে কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন, একই এয়ারলাইনসে ৫ আগস্ট তিনি দেশে ফিরে আসেন।


২০১৬ সালের ৪ মার্চ প্রি-চালান ভিসায় অফিসিয়াল ট্যুরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে ভারতে উদ্দেশে ঢাকায় ছাড়েন এবং ৯ মার্চ একই এয়ারলাইনসের দেশে ফিরেন। ২০১৬ সালের ৩ জুন ভিজিট ভিসায় থাই এয়ারলাইনসে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন এবং ৮ জুন দেশে ফিরেন। এইটা ছিলো তার বিশেষ ট্যুর। কারণ এই ভ্রমনে তিনি আনন্দ ও মাস্তিতে ছিলেন ব্যস্ত। ২০১৭ সালের ১ জুলাই ভিজিট ভিসায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন এবং ১৫ জুলাই তিনি দেশে ফিরেন।


২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ভারত ভ্রমন করেন এবং ৬ এপ্রিল তিনি দেশে ফিরেন। প্রকৌশলী সব চেয়ে বেশি ট্যুর করেছেন ভারতে। সেই দেশে ৪ বার তিনি ভ্রমন করেছেন। অভিযোগ রয়েছে দেশে টাকা পাচার করে ভারতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেন।  চাকরি করার সুবাদে সেখানে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তার মাধ্যমে অবৈধ টাকা পাচার করে ব্যবসাও শুরু করেছেন এই প্রভাবশালী নির্বাহী প্রকৌশলী। ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল চীনের একটি বিমানে অফিসিয়াল ট্যুরে বিজনেস মিটিং ভিসা চীনে সফর করেন এবং ১০ এপ্রিল দেশে ফিরেন। একই বছর ২২ নভেম্বর আবারো চীনের একটি ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে অফিসিয়াল ট্যুরে যান এই কর্মকর্তা।


 ২৮ নভেম্বর তিনি দেশে ফিরেন। ২০২২ সালের ১৭ আগষ্ট যুক্তরাজ্য অফিসিয়াল ট্যুরে যান। ২৬ আগষ্ট দেশে ফিরেন। ২০২৩ সালের ১৪ জুলাই ইতালি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছেন। ২৩ জুলাই দেশে ফিরেন। একই বছর ২০ ডিসেম্বর ইতালি সফর করেন। ২৯ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরেন। তবে অধিকাংশ ট্যুরে সফর সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান মেয়ে তাহমিদ ইনতে হাদী ও ছেলে রুয়াদ আল হাদী। এই কর্মকর্তা পাসপোর্ট নম্বর এবি ৮৬-৬৯৭।  


এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ডিপিডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মো.রাজিবুল হাদীকে ফোন করলে তাকে পাওয়া যায়নি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে উত্তার পাওয়া যায়নি।


এ ব্যাপারে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (এডমিন অ্যান্ড এইচ আর) সোনা মনি চাকমা সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার দপ্তর থেকে জানানো হয় স্যার জুম মিটিং এ আছেন। এখন দেখা করতে পারবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এডমিন অ্যান্ড এইচ আর দপ্তরকে ম্যানেজ করেই হাদী এ সব ট্যুরে অংশ নিতে পেরেছেন। তিনি সব সময় ওই দপ্তরকে তোয়াজ করে চলে।


তিনি আরো বলেন, হাদী বলেছেন তার বিরুদ্ধে নিউজ করে কিছু হবে না। ডিপিডিসির মাফিয়া ডন হাদী। তার বিরুদ্ধে যে নিউজ করবে তাকেই মামলায় ফাঁসানো হবে।


উল্লেখ্য, ডিপিডিসি’তে গত ১৬ বছর ধরে কর্মরত তিনি। যশোরের নাজির সংকরপুর তার গ্রামের বাড়ি। ২০০৭ সালে তিনি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ডিজাইন পরিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে তার চাকরি জীবন শুরু হয়। ২০০৮ সালের ৯ জুলাই তিনি ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ে (দক্ষিন শাখা) সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ডিপিডিসিতে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্য। ২০১৪ সালে তিনি সাব ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (কোম্পানি সেকেটারীয়েট) হিসেবে কাজ শুরু করেন।


রাজিবুল হাদী ডিপিডিসির খিলগাঁও ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ২০১৮ সালের ১৭ এপিল থেকে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পরে তাকে ৪ জুলাই ২০১৯ সালে জি টু জি প্রকল্পে বদলি করা হয়। খিলগাঁও ডিভিশন একটি সুত্রে জানা যায়, তৎকালীন সময় তিনি গ্রাহকদের সঙ্গে অসদাচরণ, গ্রাহক হয়রানি এবং নতুন বিদ্যুৎ সংযোগে গ্রাহকরা ঘুষ না দিলে সংযোগ না দিতে বিভিন্ন রকম তালবাহানা করতেন। পরবর্তীতে হাতে টাকা পেলে সে গ্রাহকের সংযোগ দিতো। এমনকি বিদ্যুৎ বিলের কিস্তি করাতে গেলেও তিনি সেখান থেকে উৎকোচ দাবি করতেন।


খিলগাঁও ডিভিশনের তৎকালীন কর্মচারী এক সিবিএ নেতা হাদীর এসব বিষয়ে বলতে গিয়ে জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীর রেফারেন্সে এক বিদ্যুৎ গ্রাহক উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করলে ওই গ্রাহকের কাছ থেকেও সে পরবর্তীতে এক লক্ষ টাকা ঘুষ নেয় এবং তাকে সংযোগ প্রদান করে। এই নির্বাহী প্রকৌশলীর অনিয়ম ও স্বেচ্চারিতার কারনে তৎকালীন সময় বেশ কয়েকজন বিদ্যুৎ গ্রাহক তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ডিপিডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে প্রধান কার্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ কারনে তাকে অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত না করে খিলগাঁও ডিভিশন থেকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে জিটুজি প্রকল্পে বদলি করে। দুর্নীতির অনিয়মের কারনে বদলি বা স্থানান্তর হওয়া হাদীর নতুন কিছু নয়।


সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে দক্ষিণ শাখা ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ের সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতি হুমকি ও অসদাচরণের জন্য রাজীবুল হাদীকে ওএসডি করে টঙ্গী স্টোরে সংযুক্ত রাখে ডিপিডিসি। 


জেবি/এসবি