কারবালার ময়দানে কি বলেছিলেন হয়রত ইমাম হোসেন (রাঃ)
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:২৯ অপরাহ্ন, ১৬ই জুলাই ২০২৪
মানব ইতিহাসে বহু ত্যাগের কথা আছে, বহু হাহাকার ক্রন্দনের কাহিনী আছে, বহু রক্তে লেখা বীরত্ব গাঁথা আছে, কিন্তু কারবালার কাহিনীর মত এত করুণ, ত্যাগের এত মহিমা আর নাই। ১০-ই মুহাররম কারবালার ময়দানে ঘটে যাওয়া সেই নেক্কার জনক ঘটনার দিন কি বলেছিলেন হয়রত ইমাম হোসেন (রাঃ)।
১০-ই মুহাররম ভোর বেলায় ইমাম হোসেন (রাঃ) এর শিবিরের সকলের সহিত মিলিত হইলেন। সকলের উদ্দেশ্যে ইমাম হোসেন (রাঃ) বলিলেন, এজিদ বাহিনী শুধু আমাকেই চায়। তোমাদের তাহারা বিনা কারণে বধ করিবে না। সুতরাং তোমরা আমাকে ত্যাগ করিয়া নিজ নিজ গন্তব্য স্থানে যাও। প্রাণ রক্ষা কর। ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেবের এই প্রস্তাবে সকলেই বিলাপ করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, ইমাম (রাঃ) ছাহেবকে একা রাখিয়া প্রাণ থাকিতে তাহারা কোথাও যাইবেন না। ইমাম ছাহেব প্রতি উত্তরে বলিলেন, "ভাই ও বন্ধুগণ! তোমাদের এই আত্মত্যাগ যেন আল্লাহতায়ালা কবুল করেন ও তোমাদের যেন পুরষ্কৃত করেন। অতঃপর ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেব সকলকে যুদ্ধ সাজ পরিতে বলিলেন। নিজেও যুদ্ধ সাজ পরিলেন।
অতঃপর ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেব ব্যূহ রচনা করিলেন। সেই ব্যূহতে মাত্র ৪০ জন অশ্বারোহী ও ৩৪ জন পদাতিকের একটি ক্ষুদ্র দল, তাহাদের কেহ বা গোলাম, কেহবা গৃহ ভৃত্য; কেহবা উষ্ট্রের রাখাল বা সহিস যোদ্ধা। তাহাদেরকে ডাইনে ও বামে রাখিয়া তিনি নিজের জন্য মাঝখানে স্থান নির্বাচন করিলেন ইমাম হোসেন (রাঃ)। অতঃপর অশ্ব ছাড়িয়া একটি উটের পিঠে সওয়ার হইয়া যুদ্ধ বিরতির শেষ চেষ্টা করিতে শত্রু বাহিনীর সম্মুখে হাযির হইলেন। ইমাম হোসেন (রাঃ) তাহাদের উদ্দেশ্যে বলিলেন-"হে নবী (সাঃ) এর উম্মতগণ! তোমরা যাহারা জান এবং জান না, তোমাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলিতেছিঃ আমি হযরত রাসূলে করীম (কঃ) এর নাতি, বীর শ্রেষ্ঠ হযরত আলী (কঃ) এবং জগত মাতা হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর পুত্র। আমি সেই হোসেন যাহার সম্বন্ধে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আমি বেহেশতের যুবকগণের সর্দার হইব এবং আমার বেহেশতে দাখিল আল্লাহতায়ালা কর্তৃক অংগীকারকৃত। আমি জীবনে কখনও শরীয়তের বিধি নিষেধ লংঘন করি নাই। তোমরা কি সেই হোসেনকে আজ বধ করিতে আসিয়াছ? তোমাদের কি হইয়াছে যে, তোমরা প্রিয় পয়গম্বরের প্রিয় নাতিকে বধ করিতে চাও? তোমাদের মনে কি আল্লাহ ভীতি নাই? রাসূলে করীম (সাঃ) এর প্রতি মহব্বত নাই? আমিতো কাহারও কোনো প্রকার ঋণ অপরিশোধিত রাখি নাই। কাহারও ক্ষতি করি নাই। তাহা হইলে তোমরা কেন আমার হত্যাকে হালাল মনে কর। আমিতো দুনিয়ার বাদশাহী ত্যাগ করিয়া মদীনায় আল্লাহতায়ালার ধ্যানে মগ্ন ছিলাম। শত্রুর অত্যাচারে মদীনা ছাড়িয়া মক্কায় আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিলাম।
অতঃপর তোমরা কুফা বাসীদের আমন্ত্রণেই আমি কুফায় আসিয়াছি। তোমরাতো হাজার হাজার লোক আমার নিকট বায়াত হইবার জন্য প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে। তোমরা শুধু বিশ্বাসই ভংগ কর নাই; উপরন্তু আমাকে হত্যা করিতে আসিয়াছ। আজ আমি তোমাদিগকে সেই কথাই বলিব, যাহা বলিয়া হযরত মুসা (আঃ) ফেরাউনকে আহ্বান করিয়াছিলেন। জগত স্রষ্টা আল্লাহতায়ালার নিকট আমার ও তোমাদের জন্য করুণা ও রহমত ভিক্ষা চাহিতেছি। যদি তোমরা আমাকে সহায়তা করিতে না পার, অন্ততঃ তোমরা আমাকে হত্যা করিও না। আমাকে পথ ছাড়িয়া দাও আমি মক্কা অথবা মদীনায় ফিরিয়া যাই।"
হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) এর কথায় কেহ কোনো প্রত্যুত্তর করিল না। অতঃপর আকাশের দিকে হাত তুলিয়া তিনি মুনাযাত করিলেন, "ইয়া এলাহী! আমি সংকটাপন্ন। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা।" ইমাম ছাহেব অতঃপর নিজ ব্যূহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। তিনি নিজে যুদ্ধ আরম্ভ করিবার দুর্নাম গ্রহণ করিলেন না। শত্রুপক্ষই তাহার বাহিনীর উপর প্রথমে আঘাত হানিল। প্রথমে এজিদ বাহিনীর সেনাপতি আমর তীর নিক্ষেপ করিল। অতঃপর দুইজন পদাতিক সৈন্য আসিল। যুদ্ধ শুরু হইল। কিছুক্ষণ পরেই এজিদ বাহিনী বুঝিল, অর্ধভুক্ত ও পিপাসিত হইলেও মদীনার বাহিনীর সহিত দ্বন্দ্ব যুদ্ধে টিকিয়া থাকা দুস্কর। তখন তাহারা দূর হইতে তীর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেবের বাহিনীও সাধ্যানুযায়ী উত্তর দিতে লাগিল। সেনাপতি হোর ও তাহার অনুচরগণ এজিদ বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাইয়া নিজেরা নিহত হইলেন। শহীদ মোসলেমের দুই পুত্র শহীদ হইলেন। ইমাম হোসেন (রাঃ) এর ভাগিনা জয়নাবের দুই পুত্রও শহীদ হইলেন। সেদিন জুমার দিন ছিল। জুমার নামাজ উপলক্ষেও শত্রুবাহিনী আক্রমণ বন্ধ করিল না। ইমাম ছাহেবের বাহিনী যুদ্ধ রত অবস্থায় অগ্র পশ্চাৎ করিয়া নামাজ আদায় করিলেন। ইমাম ছাহেবের বাহিনীর যে কয়জন অনুগত সেবক ছিল, তাহারা একে একে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। ইমাম বংশের সদস্যরা, কিশোর ও যুবকগণও অবশেষে যুদ্ধের সাজ পরিয়া রণক্ষেত্রে শত্রু নিধন করিয়া শাহাদাত বরণ করিলেন।
ইমাম হাসান (রাঃ) এর পুত্র মহাবীর কাসেম যুদ্ধে গমন করিলেন। মাত্র কিছু দিন পূর্বে ইমাম হোসেন (রাঃ) এর কন্যা সখিনার সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছিল। কাসেমকে যুদ্ধে যাইতে হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) বারণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নিশ্চেষ্ট অবস্থায় তিনি স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু দেখিবেন? মহাবীর কাসেম সেরূপ ছিলেন না। তিনি যুদ্ধে গমন করিয়া সিরিয়া বাহিনীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর আজকরকে হত্যা করিলেন। ইহা দেখিয়া সিরিয়া বাহিনীতে ত্রাস সঞ্চার হইল। সিরিয়া কমান্ডার আমর তখন সমস্ত সৈন্যগণকে এক যোগে মহাবীর কাসেমের উপর আঘাত হানিতে আদেশ দিল। শত্রুর সমবেত আক্রমণে তিনি প্রাণ দান করিলেন। অতঃপর জ্যেষ্ঠপুত্র আলী আকবর আসিলেন ইমাম ছাহেবের নিকট বিদায় লইতে। অশ্রু সম্বরণ করিয়া ইমাম ছাহেব তাহাকেও বিদায় দান করিলেন। কিশোর পুত্র আলী ছাদও ভাইয়ের সহিত যুদ্ধে গমন করিলেন। উভয় ভ্রাতাই শহীদ হইলেন।
একে একে তিনটি পুত্র শহীদ হইল। তখন হযরত ইমাম ছাহেব নিজ তাবুর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। স্ত্রী, কন্যা, ভগিনীদের শেষ উপদেশ দান করিলেন ও তাহাদের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন। সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র অসুস্থ্য জয়নাল আবেদীন উম্মে কুলসুমের কোলে ছিলেন। ইমাম ছাহেব বলিলেন, "এই বালকটিকে তোমরা সযত্নে রক্ষা করিও-নবী করীম (সাঃ) এর গুপ্তধন, মহামূল্য বেলায়েত, যাহা আমি আমার পিতা ও ভ্রাতার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছি; তাহা এই বালকের বক্ষে আমানত রাখিলাম। এই বালকের মাধ্যমেই নবীর বেলায়েত অর্থাৎ রূহানী জগতের অনুশাসন দুনিয়ায় জারী থাকিবে।” এই বলিয়া নবী করীম (সাঃ) এর দৌহিত্র নিজ বক্ষের সহিত পুত্র জয়নালের বক্ষ চাপিয়া ধরিলেন। অতঃপর যুদ্ধের জন্য রণক্ষেত্রে অগ্রসর হইলেন। তিনি প্রিয় অশ্ব দুলদুলে সওয়ার হইলেন, পিপাসায় কাতর ইমাম ছাহেব প্রথমে নদীর দিকে ছুটিলেন। সম্মুখে যাহাকে পাইলেন, তাহাকেই কাতেল করিলেন। এজিদ সেনাপ্রধান সীমার আমরকে বলিল, পিপাসার্ত অবস্থায়ই হোসেনের সম্মুখে কেহই দাঁড়াইতে পারে নাই। পিপাসা মিটিয়া গেলে তো কেহই তাহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারিবে না।
ততক্ষণে হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেব পানিতে নামিয়া হাতের কোষ ভরিয়া মুখে তুলিতে যাইবেন। হঠাৎ তাঁহার মনে হইল, এই পানির জন্যই একে একে তিন পুত্র প্রাণ বিসর্জন দিয়াছে-আপন স্বজন সহচরগণ প্রাণ দিয়াছেন-আর তিনি পানি পান করিবেন-তাহা হয় না। তিনি হাতের কোষের পানি ফেলিয়া দিলেন। হঠাৎ শত্রু নিক্ষিপ্ত একটি তীর আসিয়া তাহার ওষ্ঠে বিদ্ধ হইল। নদীর পানি ইমাম ছাহেবের রক্তে লাল হইয়া উঠিল। মুখের তীর বহু কষ্টে নির্গত করিয়া শত্রুর উপর আবার ঝপাইয়া পড়িলেন। তাহার সম্মুখে যে পড়িতে লাগিল সেই নিষন হইল।
সীমার তখন তাহার সৈন্যদলকে একটু দূর হইতে ইমাম ছাহেবকে ঘিরিয়া ফেলিতে আদেশ দিল। তাহার পর সকলে মিলিয়া একযোগে ইমাম ছাহেবের উপর তীর, বল্লম ও বর্শা দ্বারা আক্রমণ করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে পশ্চাৎ দিক হইতে আসিয়া একজন এজিদ সৈন্য ইমাম ছাহেবের বাম হস্তকে দিখন্ডিত করিয়া দিল। ইমাম ছাহেব ডান হাতে তলোয়ার চালাইয়া তাহাকেও দ্বিখন্ডিত করিলেন। অতঃপর সীমারের বাছাইকৃত কিছু সৈন্য এক যোগে আর একটু নিকটে আসিয়া ইমাম ছাহেবের উপর বর্শা দ্বারা আক্রমণ করিল। একটা বর্শা হযরত ইমাম ছাহেবের বক্ষে প্রবেশ করিল। তিনি ভূ-পাতিত হইলেন। অতঃপর সীমার হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেবের শিরোচ্ছেদ করিল। ইমাম ছাহেব শাহাদত বরণ করিলেন।
এই রূপে কারবালার প্রান্তরে জগতের ইতিহাসে সত্যের জন্য সব চেয়ে বড় আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটিল।
তথ্য ও সূত্রঃ খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞ্যানের আলোকে শাহসুফী হযরত ফরিদপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের নসিহত "মুহাররম"।
জেবি/এসবি