নবী করীম (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কীয় আলোচনা


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭:৪২ পিএম, ২৬শে আগস্ট ২০২৫


নবী করীম (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কীয় আলোচনা
মনিনা শরিফের ছবি।

হিজরী বর্ষ পঞ্জিকার তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। এই মাসের ১২ তারিখ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক দিবস। কারণ, ১২-ই রবিউল আউয়ালে এই ধরার বুকে আবির্ভূত হন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা, করুণার আধার, রাহমাতুল্লিল আ’লামীন, উসওয়াতুন হাছানাহ, সারওয়ারে কায়েনাত, মোফাখখারে মওজুদাত, হযরত আহমদ মুজতবা, মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)। তাহার আবির্ভাবে পুলকিত হয় জগৎ বিশ্ব, আনন্দ মুখরিত হয় গাছ-পালা, বৃক্ষ-লতা, পশু-পাখী, আসমান-জমীন, ফেরেশতা তথা সমস্ত সৃষ্টিই। প্রকৃতির হৃদয়ে আনন্দ উথলিয়া উঠে।


তিনি ছাইয়েদুল বাশার বা মানব ছরদার। তিনি রাহমাতুল্লিল আ’লামীন বা জগতসমূহের জন্য রহমত। তিনি জাতে (সত্তায়) উদ্ভুত প্রেমের প্রথম বিকাশ। তিনিই সৃষ্টির কারণ ও উৎস। তাহাকে সৃষ্টি না করিলে আল্লাহতায়ালা আর কিছুই সৃষ্টি করিতেন না। আল্লাহপাক বলেন,’(হে নবী!) আপনাকে পয়দা না করিলে আসমান-জমীন কোন কিছুই পয়দা করিতাম না।’


রাসূলে পাক (সাঃ)-ই প্রথম সৃষ্টি। তিনি আল্লাহর জাতি নূরে সৃষ্ট এবং অপরাপর সমুদয় সৃষ্ট তাঁহারই নূরে সৃষ্টি। তিনি নিজেই বলিতেন,-‘আমি আল্লাহর নূর হইতে এবং সৃষ্টি জগতের সবকিছু আমার নূর হইতে।’ তিনি তখনও নবী ছিলেন যখন আদম (আঃ) মাটি ও কাদায়।


তিনি আদম বংশের ছরদার ও ইমাম। তাঁহার মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টির তথা (ফেরেশতা, মানব, জ্বীন ইত্যাদির) হকিকত নিহিত। তিনি হাকিকাতুল হাকায়েক বা সমস্ত হকিকতের হকিকত। এই দৃষ্টিতে তিনি সকলের নবী। তিনি ফেরেশতাদের নবী, মানুষের নবী, পশু-পাখী, গাছ-পালা, বৃক্ষ-লতারও নবী, অপরাপর নবী-রাসূল (আঃ) গণেরও নবী। আল্লাহপাক এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে তিনি মধ্যস্থতাকারী। যাবতীয় নেয়ামত, রহমত তাঁহারই মধ্যস্থতায় জগতের বুকে কায়েম রহিয়াছে। 


আল্লাহতায়ালার দয়া ও করুণা যতটুকু দুনিয়ার বুকে আসিতেছে তাহা তাঁহারই পাক দেল বাহিত হইয়া আসিতেছে।

তিনি রাহমাতুল্লিল আ’লামীন বা সারা জাহানের রহমত। তাঁহারই অছিলায় হযরত আদম (আঃ) ক্ষমা পান। তাঁহারই অছিলায় হযরত নূহ (আঃ)-এর কিছতি প্লাবনের তান্ডব সত্ত্বেও রক্ষা পায়। তাঁহারই অছিলায় হযরত আইয়্যুব (আঃ) রোগমুক্তি লাভ করেন। তাঁহারই অছিলায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জন্য নমরুদের প্রজ্বলিত আগুন শান্তিময় স্থানে পরিণত হয়।

তিনি জ্ঞানে ও গুণে পরিপূর্ণ ছিলেন। আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম তাঁহারই মাধ্যমে পূর্ণত্ব পায়। তিনিই মে’রাজ লাভে ধন্য হন। তিনি খোদাতায়ালার সর্বাধিক সান্নিধ্য লাভ করেন। সৃষ্টিতত্ত্বজ্ঞান এবং স্রষ্টাতত্ত্ব জ্ঞানের পরিপূর্ণতা আল্লাহপাক তাঁহাকেই দান করেন।


তিনি সেই নবী ও রাসূল (সাঃ) যাহার উপর আল্লহপাক দরুদ ও ছালাম পাঠান, ফেরেশতারাও ছালাম পাঠায়। তিনি সেই নবী (সাঃ)- যাহার নাম আল্লাহর আরশে লিখিত। শুধু আরশে নহে, প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি অণু-পরমাণুতে আল্লাহর নামের সঙ্গে তাঁহার নাম অংকিত আছে। সৃষ্টির প্রতি অণু-পরমাণুর বক্ষে কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” অংকিত আছে। আসমান-জমীন ব্যাপী এই কলেমার জেকের হইতেছে। যাহাদের রূহ জান্নাত, কালব পরিচ্ছন্ন-তাহারা উল্লিখিত তথ্য নিজ হইতেই বুঝিতে পারে।


তাঁহার নবুয়ত ও রেসালতের স্বীকৃতি দেয় প্রত্যেক সৃষ্টি। পাথর তাঁহাকে ছালাম দেয়, বৃক্ষ সেজদা করে, পশুও সেজদা করে। একমাত্র নাফরমান মানুষ তাঁহার নবুয়ত ও রেসালতের শ্রেষ্ঠত্ব মানিতে চায় না।


তিনি আদম বংশের গৌরব। নবী ও রাসূল (আঃ) গণের ছরদার। তিনিই প্রথম কবর হইতে উঠিবেন। তিনিই সর্বাগ্রে শাফায়াত করিবেন এবং তাহারই শাফায়াত সর্বপ্রথম কবুল করা হইবে। তাঁহারই হাতে আল্লাহপাকের প্রশংসার ঝান্ডা থাকিবে। সেই ঝান্ডার নীচে সমবেত হইবে সকল নবী-রাসুল, মোমিন-মুসলমান ও ফেরেশতা। তিনিই প্রথমে জান্নাতের দরজায় আঘাত করিবেন। তাঁহারই জন্যে প্রথমে জান্নাতের দরজা খোলা হইবে। হাশরের ময়দানে একমাত্র তিনিই ইয়া উম্মতি, ইয়া উম্মতি করিয়া ছুটাছুটি করিবেন। অন্য সকলেই ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি বলিবে। তাঁহার উম্মতের সংখ্যাই সর্বাধিক থাকিবে। তাঁহার শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তদীয় উম্মতেরাও অন্যান্য উন্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হইবে। উম্মতে মুহাম্মদীকে তাই বলা হয় “খায়রুল উমাম” বা সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য উন্মতের পূর্বে উম্মতে মুহাম্মদীই প্রথম বেহেশতে প্রবেশ করিবে।


তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘আমি (দুনিয়াতে) সব (নবীদের) শেষে আগমন করিয়াছি। কিন্তু কিয়ামতের দিন সকলের আগে থাকিব।’


তিনি আরও এরশাদ করেন। আমি গৌরব ব্যতিরেকেই বলিতেছি যে আমিই সর্বশেষ নবী- আর এতদসম্পর্কে আমার কোন অহংকার নাই। আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মোত্তালিব। আল্লাহতায়ালা সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমাকে উহার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে বানাইয়াছেন। অতঃপর তিনি মানুষকে দুইভাবে বিভক্ত করিয়াছেন এবং আমাকে উহার উত্তম অংশে সৃষ্টি করিয়াছেন। পরে তিনি মানুষের মধ্যে গোত্র ও খান্দান সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমাকে উহার শ্রেষ্ঠ খান্দান হইতে বানাইয়াছেন। অতঃপর তিনি মানুষের জন্য গৃহিণী তৈরী করিয়াছেন এবং আমাকে উত্তম গৃহিণী হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন। কাজেই আমি জাত ও বংশ মর্যাদার দিক দিয়া সর্বশ্রেষ্ঠ। 



কিয়ামতের দিন যখন লোকদিগকে উত্থিত করা হইবে, তখন আমিই সর্বপ্রথম কবর হইতে নির্গত হইব। যখন মানুষেরা আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রতিনিধি হিসাবে গমন করিবে, তখন আমি তাহাদের নেতা হইব। যখন তাহারা সকলেই নিশ্চুপ থাকিবে, তখন আমি একমাত্র বক্তা হইব। যখন তাহাদের সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত হইবে, তখন কেবলমাত্র আমারই সুপারিশ কবুল করা হইবে। আর যখন তাহারা নিরাশ হইবে।


 তখন আমিই তাহাদের সুসংবাদদাতা হইব। সম্মান, বুজর্গী এবং নাজাতের চাবিকাঠি সেদিন আমার হাতেই থাকিবে। হামদের ঝান্ডা সেদিন আমার হাতেই থাকিবে। আওলাদে আদমের মধ্যে আমিই সবচাইতে সম্মানীয় হইব। আমার চতুর্দিকে সেদিন এক হাজার খাদেম ঘোরাফেরা করিতে থাকিবে যাহারা উজ্জ্বল মোতির ন্যায় হইবে। আর কিয়ামতের দিন আমিই সমস্ত আম্বিয়াদের ইমাম, তাহাদের বক্তা এবং শাফায়াতের অধিকারী হইব। আর এ ব্যাপারে আমার কোন গর্ব নাই।

নবীজী (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধির জন্য নিম্নের ঘটনাটি প্রাণিধানযোগ্য।


এক সিরিয়া নিবাসী ইহুদী ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া স্বধর্ম ত্যাগপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করিলেন। ইসলাম গ্রহণ করিলেন সত্য, কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে তখনও তিনি দেখেন নাই। তাঁহার একান্ত বাসনা, প্রাণের অতৃপ্ত কামনা নবীজীকে দুই চোখ ভরিয়া দেখার। সেই অতপ্ত আকাঙ্খা লইয়া সিরিয়া হইতে মদীনার দিকে যাত্রা শুরু করিলেন। কয়েকদিন একাধারে পথ চলিয়া মদীনায় পৌছাইলেন। 


কিন্তু মদীনাতে আসিয়া শুনিতে পান যে মাত্র তিনদিন পূর্বে নবী করীম (সাঃ) ইহধাম ত্যাগ করিয়া খোদার সান্নিধ্যে চলিয়া গিয়াছেন। এক বুক আশা লইয়া মদীনায় আসিয়াছেন নবীজীকে দেখার জন্য, অথচ বদনসিব, মাত্র তিনদিনের জন্য তিনি নবীজীর সাক্ষাত পাইলেন না। তাহার আর দুঃখের সীমা থাকিল না। হায় নবীজী। হায় নবীজী। রবে অবোরে কাঁদিতে লাগিলেন। তাহার হৃদয়ের জ্বলন্ত অগ্নি তিনি এখন কিভাবে নির্বাপিত করিবেন? ভাবিলেন, নবী করীম (সাঃ) এর গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সাহাবীগণের নিকট হইতে কিছু শুনিতে পাইলে হয়তো তাহার দেলের আগুন কিছুটা হ্রাস পাইবে।


তাই কতিপয় সাহাবার নিকট যাইয়া রাসুলে পাক (সাঃ) এর অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য জিজ্ঞাসা করিলেন। সাহাবাগণও নবীজীর বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় যেমনি কাতর, তেমনি শোকে শোকাতুর ছিলেন। প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাবে বলিলেনঃ প্রিয় নবী (সাঃ) এর গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নহে। তবে আপনি হযরত বেলাল (রাঃ) ছাহেবের সহিত দেখা করিতে পারেন। কেননা তিনি ছায়ার মত সারাজীবন নবীজীর সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু হযরত বেলালকে যখন ঐ ব্যক্তি প্রিয় নবী (সাঃ)-এর অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়ার অনুরোধ করিলেন, তখন তিনি বলিলেন, ‘আমার পক্ষে রাসূলে পাক (সাঃ)-এর একটি বিবরণও পেশ করা সম্ভব নয়। 


আপনি বরং হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর শরণাপন্ন হন। তিনি তদীয় মহান পিতা সম্পর্কে সম্ভবতঃ কোন বিবরণ দিতে পারিবেন। হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর নিকট আরজ করিলে তিনি বলিলেন, আমার মহান আব্বাজানের প্রকৃত অবস্থার বিবরণ দেয়া আমার সাধ্যাতীত। আপনি এই উদ্দেশ্যে হযরত আলী (রাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করুন। তিনি হয়তো এই সম্পর্কে আপনাকে একটি বিবরণ দিতে পারিবেন। এই ব্যক্তি হযরত আলী (রাঃ) এর নিকট গমনপূর্বক তাঁহার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিলেন।


হযরত আলী (রাঃ) ছাহেব বলিলেন, পৃথিবীতে যত কিছু আছে তাহার একটা বিবরণ আপনি প্রথমে আমার নিকট পেশ করুন। লোকটি বলিলেন, পৃথিবীতে অগণিত দ্রব্য সম্ভার আছে। এখানে মহান খোদাতায়ালার অনন্ত অসীম কুদরত ও হেকমতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ তাহার কত বিস্ময়কর সৃষ্টি আছে তাহা জানা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নহে। অতএব পৃথিবীতে যত কিছু আছে তাহার বিবরণ পেশ করা কিভাবে আমার পক্ষে সম্ভব হইতে পারে? তৎক্ষণাৎ হযরত আলী (রাঃ) ছাহেব বলিলেন, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে পৃথিবীর যাবতীয় দ্রব্য সামগ্রীকে কালীল (৪:৭৭) বা সামান্য বলিয়াছেন আর প্রিয় নবী (সাঃ)-এর চরিত্র মাধুর্যকে ‘খুলুকে আজীম’ (৬৮:৪) বা মহান শ্রেষ্ঠ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। 


যে বিষয়কে আল্লাহতায়ালা নগণ্য বলিয়াছেন তাহার বিবরণ দেওয়াই আপনার বা আমার পক্ষে সম্ভব হইতেছে না অথচ প্রিয় নবী (সাঃ) এর জীবন-চরিতকে ‘মহান শ্রেষ্ঠ’ বলিয়াছেন তাঁহার বিবরণ দেয়া আমার পক্ষে কি করিয়া সম্ভব হইতে পারে?

সেই খুলুকে আজীম, শ্রেষ্ঠতম মানব, নবীদের ইমাম, রাহমাতুল্লিল আ’লামীন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ই তারিখে এই নশ্বর দুনিয়ায় তশরিফ রাখেন।


৬৩ বৎসর অন্তে আবার এই দিনেই তিনি দুনিয়া ত্যাগ করিয়া দারুল বাকায় চলিয়া যান। তাঁহার আবির্ভাব ও তিরোভাব দিবস হিসেবে ১২ই রবিউল আউয়াল মুসলিম জাহানের নিকট সমাদৃত, সম্মানিত। মহা ধুমধামে পালিত হয় এই দিবস।


সূত্র: বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী 


এসডি/