নওগাঁয় গাছে গাছে দুলছে মুকুল, রেকর্ড পরিমান আম উৎপাদনের আশা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


নওগাঁয় গাছে গাছে দুলছে মুকুল, রেকর্ড পরিমান আম উৎপাদনের আশা

ধানকে ঘিরে দেশের শস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। ধানের পাশাপাশি এই জেলা এখন সারাদেশে আমের নতুন রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে এই আমের চাষাবাদ। গতবারের চেয়ে গাছে মুকুল ও আমরে গুটি এসেছে বেশি। তাই ফলনও ভালো পাওয়ার আশা করছেন বাগান মালিকরা। তবে বাগান মালিকদের দাবি বিদেশে বেশি পরিমানে আম রপ্তানি করা গেলে তারা আরও লাভবান হবেন। এছাড়াও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে এবার নওগাঁতে আম উৎপাদনে সব রেকর্ড ছাড়াতে পারে।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে নওগাঁয় আম বাগান ছিল ২৪ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন হয়েছিল ১২ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন আম। যার বিক্রয় মূল্য ছিল প্রায় ১ হাজার ৪৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গত ২০২০-২১ মৌসুমে আমবাগান ছিল ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন হয়েছিল ১৩ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৫ মেট্রিক টন আম। যার বিক্রয় মূল্য ছিল প্রায় ১ হাজার ৫৭০ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে জেলায় ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন আম। যার বিক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৪২ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও গতবারের চেয়ে জেলায় এবার ৩ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আমচাষ বেশি হওয়ায় উৎপাদন অন্য যে কোনো সময়ের রেকর্ড ভাঙবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ।

চলতি মৌসুমে উপজেলা ভিত্তিক আম চাষের পরিমান হলো-সদর উপজেলায় ৪৪৫ হেক্টর, রানীনগরে ১১০, আত্রাইয়ে ১২০, বদলগাছীতে ৫২৫, মহাদেবপুরে ৬৮০, পত্নীতলায় ৮ হাজার ৮৬৫, ধামইরহাটে ৬৭৫, সাপাহারে ১০ হাজার, পোরশায় ১০ হাজার ৫২০, মান্দায় ৪০০ ও নিয়ামতপুরে ১ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে।

নওগাঁ জেলার বিভিন্ন আম বাগান সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আম বাগানগুলো মুকুলে মুকুলে ছেয়ে গেছে। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে মুখরিত পুরো এলাকা। যে দিকে তাকায় গাছে গাছে এখন শুধু দৃশ্যমান সোনালী মুকুলের আভা। মুকুলের ভারে নুয়ে পড়ার উপক্রম প্রতিটি গাছ। মৌমাছিরাও আসতে শুরু করেছে মধু আহরণে। অবার কিছু কিছু গাছে ইতিমধ্যে আমের গুটি ফোটতে শুরু করেছে। আমের ভালো ফলনের আশায় গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পারছেন বাগান মালিকরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিকরা। এদিকে আমের ভালো ফলন পেতে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষি অফিস।

জেলার পোরশা উপজেলার আম বাগান মালিক বাবুল হোসেন বলেন, এবার গাছে বিপুল পরিমাণ মুকুল এসেছে। কিছু কিছু গাঝে গুটিও আসতে শুরু করেছে। তাই ফলন ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আবহাওয়াটা একটু ভালো থাকলেই হয়। তিনি আরো বলেন, গাছে মুকুল থাকাকালে কয়েক বার বৃষ্টির প্রয়োজন। বৃষ্টি হলেই চিন্তা নাই। আর বৃষ্টি না হলে ওষুধ মেশানো পানি গাছের মুকুলে স্প্রে করতে হবে, যাতে মুকুল ঝরে না পড়ে।

সাপাহার উপজেলার আইহাই  গ্রামের আম বাগান মালিক মাহফুজুর রহমান বলেন, আমি ২৪বিঘা জমিতে বিঘা জমিতে আম চাষ করেছি। গত বছরের চেয়ে এবার ৪বিঘা জমিতে বেশি আবাদ করেছি। বাগানের সবগাছে মুকুল আসছে। সে কারণে এইসময়ে গাছে পোকার আক্রমণ না করতে পারে, মুকুল যেন ভালো থাকে সেজন্য কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এতে করে মুকুলে পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারবে না। মুকুলগুলোও ভালো থাকবে ও ভালো ফলন আসবে। এছাড়া গাছের গোড়ায় গর্ত করে সেখানে সার দেওয়া হচ্ছে যাতে গাছে পরিপূর্ণ মুকুল আসে ও ভালো আম ধরে।

একই উপজেলার পাতাড়ি গ্রামের আমচাষি শাকিব হোসেন বলেন, আমি অন্যর জমি বিভিন্ন মেয়াদি লিজ নিয়ে ৩৫ বিঘা জমিতে আমের বাগান করেছি। তাতে আম্র্রপালি, বারি ফোর, গৌড়মতি ও আশির্^না জাতের ৩ হাজার ৫০০ অধিক আম গাছ রয়েছে। এবারে গাছে যথেষ্ট পরিমাণ আমের মুকুল এসেছে, মুকুল যেন ঝড়ে না পরে সে কারণে মুকুল রক্ষায় গাছের পরিচর্যায় বিভিন্ন ধরনের সুষম খাবারসহ সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু গাছে ইতিমধ্যে আমের গুটি আসতেছি। অল্পদিনের মধ্যে পুরোপুরি চলে আসবে। প্রতি বিঘায় সার,সেচ, ওষুধ, শ্রমিকসহ খরচ পড়ে প্রায় ৩৫-৩৫হাজার টাকার মত। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে দাম ভালো পাই তবে বিঘা প্রতি সব খরচ বাদ দিয়ে দেড় লক্ষ টাকার মত লাভ হবে। বর্তমানে অতিরিক্ত খড়ার কারনে কিছু মুকুল ঝড়ে যাচ্ছে। তবে বৃষ্টি হলে আর ঝড়বে না মুকুল। কৃষি অফিস এর পরামর্শে ওষুধ স্প্রে করছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ বলেন, আম চাষ লাভজনক ও আম চাষের জন্য মাটি উপযোগী হওযায় দিন দিন এই জেলায় আম বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে নওগাঁ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এখানে বেশ ভালো আম চাষ হয়। চলতি বছর এই জেলায় ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। যা থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন আম। যার বিক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৪২ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও গতবারের চেয়ে জেলায় এবার ৩ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আমচাষ বেশি হওয়ায় উৎপাদন অন্য যে কোনো সময়ের রেকর্ড ভাঙবে বলে মনে করেন তিনি। চলতি মৌসুমে আমের জন্য আবহাওয়া এখনো বেশ অনুকূলে থাকায় আম গাছে মুকুল বেশ ভালো আসছে। এইসময়ে সাধারণত হুপার পোকার আক্রমণ করে। যার কারণে আমের মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া বিচিং পদ্ধতিতে সেচ না দেওয়ার কারণে মুকুল শুকিয়ে ঝড়ে পড়ে। এগুলো থেকে রক্ষা পেতে ও ফলন ভালো পেতে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে আমচাষিদের সবধরনের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। আমচাষিরাও সে মোতাবেক গাছের পরিচর্যায় ব্যাস্ত সময় পার করছেন। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে এবারে আমের ভালো ফলনের আশা করছি। কিছু মুকুল ঝড়ে যাচ্ছে তবে এতে করে তেমন কোন সমস্যা হবেনা। প্রতিটি গাছের ডগাগুলো পর্যাপ্ত পরিমান মুকুল থাকে। খড়ার কারনে এমনটা হচ্ছে। চাষিদের কৃষি অফিস থেকে নির্দেশিত ওষুধ স্প্রে করতে বলা হয়েছে।

এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, আম্র্রপালি, বারি ফোর, গৌড়মতি, আশির্^না, নাগফজলি, হিমসাগর, ফজলি, গোপলভোগ, লেংড়া, খিরশাপাতসহ বিভিন্ন প্রজাতির আম চাষ হয়। এখানকার আমের খেতে অনেক সু-স্বাদু ও মিষ্টি। পাশ্ববর্তী রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ব্যাবসায়ী ও আম চাষিরা নওগাঁ এসে আমের বাগান কিনে তাদের জেলার আম বলেও প্রচার করে থাকে। বিদেশে আম রফতানির চিন্তা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে স্বল্প পরিসরে আম বিদেশে রফতানি হয় এই জেলা থেকে। কিন্তু এবার আম রফতানির সকল নির্দেশনা মেনে বড় পরিসরে আম বিদেশে রফতানির চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।

এসএ/