নতুন সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:০৩ অপরাহ্ন, ৯ই আগস্ট ২০২৪


নতুন সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে সরকার পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় কয়েকদিন ধরে যে শূন্যতা, সেটির অবসান হলো ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে। তবে শুরু থেকেই নতুন এই সরকারকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ নতুন এই সরকার এমন একটা সময়ে দায়িত্ব নিচ্ছে যখন দেশে পুরোদমে ভেঙ্গে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রশাসন এবং অন্যান্য সেক্টরেও চলছে চরম অস্থিরতা। আরও আছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। এর সঙ্গে আছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিপুল প্রত্যাশা। কিন্তু সবমিলিয়ে নতুন সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো তা নিয়ে চলছে বিভিন্ন আলোচনা।


আইনশৃঙ্খলার কী হবে?


সরকার পতনের পর ঢাকার প্রায় সব থানা থেকে সরে যায় পুলিশ সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় হয় হামলা। মূলত আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা, গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে বহু মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার থানায় উত্তেজিত জনতার হামলায় পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনাও আছে। সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট এখন প্রকট।


বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ডাকাতি, লুটপাট, ভাঙচুর। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।


তিনি বলেন, এখানে এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনগণ -কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দু’পক্ষই অনিরাপদ বোধ করছে। এই জায়গায় একটা বিশ্বাস এবং আস্থা খুব দ্রুতই তৈরি করতে হবে।


আরও পড়ুন: অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রথম বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত 


তার মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে যে দুর্নীতি, নির্যাতনের সংস্কৃতি এবং জনগণের সেবা না পাওয়ার ইতিহাস সেটা বদলাতে হবে। কোনো অনিয়ম হলে সেটার প্রতিকার যদি হয়, তাহলে মানুষের আস্থা ফিরবে। এক্ষেত্রে আগে সরকারের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি।


জোবাইদা নাসরীন বলেন, সরকার আসলে এসব বাহিনীকে ব্যবহার করে। সুতরাং সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব পরিবর্তন হলে বাহিনীর ভেতরেও সংস্কার আসবে। এসব বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে।


দরকার রাষ্ট্র সংস্কার


বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার ওপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের আগেই এসব বিষয়ে এখন সংস্কারের তাগাদা দিচ্ছেন অনেকেই।


পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই এখন কমবেশি সংস্কার করতে হবে।


তিনি বলেন, আমাদের এখানে দুর্নীতি বড় সমস্যা। সুতরাং দুর্নীতি দমন কমিশনের কী হবে, বিচার বিভাগের কী সংস্কার হবে, র‍্যাব থাকবে কি না এরকম অনেক বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে।


আরও পড়ুন: নতুন সরকারের ‘সহ-উপদেষ্টা’ হিসেবে যুক্ত হবেন শিক্ষার্থীরা: নাহিদ


অন্যদিকে, রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, সাংবিধানিক যতো প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেভাবে সংস্কার করতে হবে। তাহলে সেটা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে দুর্নীতির মতো কাজ থেকে দূরে রাখবে।


তিনি বলেন, অতীতে কিন্তু এখানে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে।


অর্থনীতি: ‘মানুষকে দ্রুত কিছু রেজাল্ট দেখাতে হবে’


বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে জনজীবনে ক্ষোভ-অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সব ধরনের মানুষের অংশ নেওয়ার পেছনে সেটাও একটা বড় কারণ বলেই উঠে এসেছে।


রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নিম্নমুখী। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি অসহনীয় অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন সরকারকে গণআস্থা ধরে রাখতে হলে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।


তিনি বলেন, দুই-তিন মাসের মধ্যেই অর্থনীতির কিছু বিষয়ে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি চার/পাঁচ মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে নামিয়ে আনতে হবে। মুদ্রা বিনিময় হারকে স্বাভাবিক করতে হবে, রিজার্ভ একটু বাড়াতে হবে। এগুলো দ্রুত করতে হবে। মানুষকে দ্রুত কিছু রেজাল্ট দেখাতে হবে।


কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সফলতা কি দ্রুত পাওয়া সম্ভব? আহসান এইচ মনসুর অবশ্য বলছেন এটা অসম্ভব নয়। তিনি বলেন, পশ্চিম অনেক দেশই ছয় মাসের মধ্যেই ইনফ্লেশন দশ-বারো শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। আমাদের এখানেও সম্ভব। আমরা এতোদিন প্রয়াজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারিনি বলেই হয়নি। এখানে মুদ্রার হার বাজারভিত্তিক রাখতে হবে, টাকা ছাপিয়ে সরকারের ব্যয় মেটানো যাবে না, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া যাবে না। এগুলো যদি করতে পারে এবং বিদেশি সহায়তা পায় তাহলে অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে বাধ্য।


নতুন সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে


শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজ যেসব রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু এর মধ্যেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যেই ঢাকায় মাঠে নেমে বুধবার সমাবেশও করেছে বিএনপি। দলটি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে বলেছে। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবেলায় তিন মাস যথেষ্ট নয় বলেই আলোচনা আছে।


আরও পড়ুন: গুরুত্বপূর্ণ ২ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন সালেহ উদ্দিন


আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বল্প সময়ের জন্য কোনো সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবে না। আর সংস্কার না হলে সেটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে না।


তিনি বলেন, সরকার যদি তিন মাসের জন্য আসে, ছয় মাসের জন্য আসে তাহলে সংস্কারে হাত দিয়ে লাভ নেই। আমরা আরেকটা ডিক্টেটরশিপ (স্বৈরতন্ত্র) পেয়ে যাবো এবং আরেকটা পরিবারতন্ত্র আসবে। এখানে বড় পরিবর্তনের জন্য তিন থেকে ছয় বছর সময় লাগবে।


তবে অন্তর্র্বতী সরকার দীর্ঘ হওয়ার বিপক্ষেও যুক্তি আছে। কারণ এই সরকার নির্বাচিত নয় এবং নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দলও নেই।


আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখানে ঢালাওভাবে দুই থেকে তিন বছর সময় নিয়ে সংস্কার করবো এরকম একটা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ কম। আবার তড়িঘড়ি করে রাজনৈতিক দলগুলো চায় বলেই নির্বাচন দিতে হবে সেটা করাও নতুন সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে তৈরি করতে যে সময় দরকার সেটাই নিতে হবে। দীর্ঘ সময় লাগলে সেটা দেশেও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।


সবমিলিয়ে সরকারের সামনে বেশ বড় বড় চ্যালেঞ্জই এখন সামনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নতুন সরকারকে এগুতে হবে বলেই মত তার। সূত্র: বিবিসি বাংলা


এমএল/