এনআরবিসি ব্যাংকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৪


এনআরবিসি ব্যাংকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা
ফাইল ছবি

বেনামী শেয়ারহোল্ডার, দুর্নীতির দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত সাবেক পরিচালক ও সাবেক কিছু কর্মকর্তা মিলে এনআরবিসি ব্যাংকের পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তারা বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার লিপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে আবার লুটপাট করার অপকৌশলে লিপ্ত হয়েছে।


গত ২৩ আগস্ট এনআরবিসি ব্যাংকের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বরাবর দেওয়া চিঠিতে এ-সব তথ্য জানা যায়।

 

চিঠিতে বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার দাপটে দেশের ব্যাংকিংখাত চরম বেকায়দায় পড়ে। কিন্তু এরমধ্যে ব্যতিক্রম ছিল এনআরবিসি ব্যাংক। প্রভাবশালীদের ঋণ বিতরণ করা থেকে বিরত হয়ে এনআরবিসি ব্যাংক গ্রাম-বাংলার মানুষদের উন্নয়নে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করছে। দেশের অর্থনীতি যখন ক্রান্তিকাল পার করছিল সেই মূহূর্তে এনআরবিসি ব্যাংক বিশেষ ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু করে গত দুইবছরে বিনা-জামানতে স্বল্প সুদে অন্তত ১ লাখ মানুষকে ঋণ দিয়েছে।


এনআরবিসি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাননি কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যার ফলে এনআরবিসি ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গিয়েছে। এক সময় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ব্যাংকটি সমসাময়িক সকল ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে।


২০১৭ সালের পরবর্তী ৭ বছরে এনআরবিসি ব্যাংকের সকল আর্থিক সূচকে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। নিট মুনাফা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আমানত সংগ্রহ প্রায় সাড়ে ৪ গুণ বেড়েছে। ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫ গুণ। জনবল বেড়েছে ৭ গুণেরও বেশি। পরিচালনা পর্ষদের সঠিক নির্দেশনা এবং ম্যানেজমেন্টের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এনআরবিসি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। কর্পোরেট খাতে ঋণ পুঞ্জিভূত না করে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প এবং সরকারি বিল-বন্ডে বেশি ঝুঁকছে এনআরবিসি ব্যাংক।


ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তুলে প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে ব্যাংকটি। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিতরণকৃত ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে  ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এসএমই খাতে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা এবং বিনা জামানতে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বাইরে রিটেইল ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।


চিঠিতে আরও জানা যায়, এনআরবিসি ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকটির লাইসেন্স হাতিয়ে নেন। লাইসেন্স নেওয়ার শুরুতেই ব্যাপক চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হন তিনি। উদ্যোক্তাদের কাছে প্রায় দ্বিগুণ দামে শেয়ার বিক্রি করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা এবং অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার নামে আরও টাকা আদায় করেন। এই টাকা দিয়ে নিজের পরিবারের ১৬ জন সদস্যের নামে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কিনে উদ্যোক্তা বনে যান।


ব্যাংক পরিচালনার শুরুতেই নিজে এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের নিয়ে অপকর্মে লিপ্ত হন তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। তার অপকর্মের অংশীদার ছিলেন তৌফিক রহমান চৌধুরী, এনায়েত হোসেন,  সনোয়ার আলী, সরোয়ার জামান চৌধুরী, কামরুন নাহার সাকী, শামীম আলী, আশরাফ আলী, ফারুক আলী, ইজাহারুল ইসলাম হালদার, সাখাওয়াত আলী, জাহাঙ্গীর আলম, এসএম গোলাম রাব্বানী চৌধুরী প্রমুখ। এদের অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।  এদের মধ্যে বেনামী শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন।


আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে এক দিনের বেতন প্রদান অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি’র 


ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশে বসবাসরত কয়েকজন ব্যবসায়ীকে বেনামে শেয়ার কিনিয়েছিলেন ফরাসত আলী। খাতাকলমে শেয়ারের মালিক প্রবাসী দেখানো হলেও অনেক শেয়ারের সুবিধাভোগী বাংলাদেশে বসবাসরত ব্যবসায়ীরা। কামরুন নাহার সাকীর নামে থাকা শেয়ারের প্রকৃত মালিক শহীদুল আহসান, এনায়েত হোসেনের শেয়ারের প্রকৃত মালিক খান মুজিবুর  রহমান, আমির হোসেনের শেয়ারের প্রকৃত মালিক মাকসুুদুর রহমান এবং সরোয়ান জামান চৌধুরীর নামে দেখানো শেয়ারের প্রকৃত মালিক মামুন মুছা মিয়া। আইন অনুযায়ী বেনামে শেয়ারহোল্ডার দন্ডনীয় অপরাধ এবং শেয়ারগুলো রাষ্ট্রের অনুকুলে বাজেয়াপ্তযোগ্য। সেই প্রক্রিয়া শুরু হলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা করতে দেয়নি ফরাসত আলী।


চিঠিতে বলা হয়েছে, তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে থেকে এনআরবিসি ব্যাংক ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে মেতে ওঠেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বহুবছর।  তবে শেষরক্ষা হয়নি। দুর্নীতির কারণে ফারমার্স ব্যাংক (পরবর্তীতে পদ্মা ব্যাংক) বন্ধের উপক্রম হলে এনআরবিসি ব্যাংকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীসহ ৬ পরিচালককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং তাকে ২ বছরের জন্য আর্থিকখাতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।


আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতার আসার পর ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী আবারও বেপরোয়া  হয়ে ওঠেন। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবার পর আবারও ব্যাংকটিকে দখলের জন্য মরিয়া হয়ে  ওঠে ফরাসত আলী। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হন এনআরবিসি ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারীসহ অসততার দায়ে চাকরি হারানো কয়েকজন কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন ডিএমডি শাফায়েত ওয়াহেদ. সৈয়দ মো. মহররম হোসেন, মাহফুজুর রহমান, রিয়াজ উদ্দিন আসিফ প্রমুখ।


ব্যাংকটির সুনাম ধ্বসিয়ে ব্যাংকটিকে বেকায়দায় ফেলতে ২০২০ সাল থেকে সরকারের নানা দফতর ও গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে চলেছেন। এক্ষেত্রে অনেক পরিচালক, উদ্যোক্তা, শেয়ারহোল্ডার এবং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে তাদের নামেও চিঠি পাঠিয়েছেন। সব সময় তারা এনআরবিসি ব্যাংককে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। গত ৫ আগস্ট তাদের আওয়ামী সরকারের পতনের পর তারা আবার ভোল পাল্টে সেই একই তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন। তাদের লক্ষ্য চূড়ান্তভাবে এনআরবিসি ব্যাংককে ধ্বংস করা। সেই ধ্বংসের পায়তারা হিসেবে ব্যাংকটির পরিবেশ অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সামষ্টিকভাবে নানাভাবে অপপ্রচার ও অপকৌশলে লিপ্ত হয়েছেন।    


আরও পড়ুন: এস আলম গ্রুপের সম্পদ না কেনার আহ্বান গভর্নরের


চিঠিতে দাবী করা হয়েছে, ধ্বংস থেকে শীর্ষে যাওয়ার সফলতম উদাহরণ এনআরবিসি ব্যাংক। কিন্তু বড়ই পরিতাপের  বিষয় যে, ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিজয়ের পর অসাধু চক্রটি তাদের পূর্বের ভোল পাল্টিয়ে এনআরবিসি ব্যাংক দখল করতে আবারো মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা ব্যাংকটিকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে মাননীয় উপদেষ্টাবৃন্দের দফতর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং  এনআরবিসি ব্যাংকের কর্মকতাদের কাছে ভিত্তিহীন বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষন করার মাধ্যমে এনআরবিসি ব্যাংকটির গতি রোধ না করে সামনের দিকে কিভাবে আরো এগিয়ে নেয়া যায় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সুবিবেচ্য দিক নির্দেশনা কামনা করছেন।


জেবি/এসবি