টেকনাফ এখন রোহিঙ্গা ভাড়াটিয়ার শহর


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫:১৭ অপরাহ্ন, ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২৪


টেকনাফ এখন রোহিঙ্গা ভাড়াটিয়ার শহর
ফাইল ছবি।

রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও সামরিক জান্তার লড়াইয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ায় একটা বড় অংশ প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ‘প্রতিদিনই’ বাংলাদেশে ঢুকছে। এসব অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা এখন ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজারে টেকনাফের গ্রামগঞ্জে। অনেকে ক্যাম্পে না গিয়ে শহরে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছে। আবার কেউ কেউ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। 


সোমবার (০৯ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফের পৌর শহরসহ বিভিন্ন এলাকা ও লোকলয় ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে প্রত্যাক এলাকায় রোহিঙ্গাদের ভরে গেছে। এরপরও প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। 


আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিনে যাত্রীবাহি ট্রলারে আবারও মিয়ানমার থেকে গুলি বর্ষণ


তবে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও সম্প্রতি সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে অন্তত আট হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার তথ্য জানিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি-রোহিঙ্গা নেতাদের মতে রাখাইনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অর্ধলাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে ঢুকে পরেছে বলে জানিয়েছেন।  


সীমান্তে আমরা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের প্রতিহত করছি উল্লেখ করে টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যাতে নতুন করে কোন রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্তে টহল জোরদার রেখেছি।’  


এদিকে কয়েকদিন আগে রাখাইনের মংডুর নয়াপাড়া গ্রাম থেকে প্রাণে বাচঁতে পালিয়ে এসে আশ্রয় ফিরোজ কামাল পরিবার টেকনাফের গোদারবিলে একটি ভাড়াবাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। টিনসেড ছয় কক্ষের ভাড়া বাসায় আরো দুই রোহিঙ্গা পরিবার ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছেন বেশ কয়েকদিন ধরে। 


কেন রাখাইন থেকে পালিয়ে আসছে জানতে চাইলে জবাবে ফিরোজ কামাল বলেন, ‘রাখাইনে এক ভায়বহ পরিস্থিতি যাচ্ছে। সেখানে থাকার অবস্থা নেই। খাবার নেই, থাকার ঘর, নেই অসুস্থত মানুষের চিকিৎসা। প্রতিদিন জান্তা সরকার আরকান আর্মির যুদ্ধে মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু, নারীসহ বহু মানুষ। বিশেষ করে সেদেশে সীমান্তে পালিয়ে আসতে জড়ো হওয়া লোকজনের উপর ড্রোন হামলা হচ্ছে। এতে শতশত মানুষ মারা যাচ্ছে।’ 


তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর ভয়ে নৌকায় নাফনদী পেরিয়ে এপারের টেকনাফের বরইতলী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের সময় আরো ১৪ জন রোহিঙ্গা ছিল। যারা পালিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের স্থানীয় দালাল ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে। মূলত ক্যাম্পে থাকার জায়গা না পেয়ে এখানে ভাড়া বাসায় উঠেছি। মাসে ৪ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হচ্ছে। বিদেশে স্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে কষ্ট দিন পার করছি। কথা বলার সশয় তার হাতে রবি সিমের একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনও হাতে ছিল।’ 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন করে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয়দের ভাড়া বাসায় ও গ্রামে- গ্রামগঞ্জে। অধিকাংশ গ্রামের ভাড়া বাসায় রোহিঙ্গা ভাড়াটিয়া পাওয়া গেছে। এতে স্থানীয় সাধারন মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। বিশেষ করে টেকনাফ শিলবনিয়া পাড়া, নাইট্যংপাড়া, গোদারবিল, পুরান পল্লান পাড়া, উপজেলা, নাজির পাড়া, সাবরাং, দক্ষিন জালিয়া পাড়া, কায়ুখখালী পাড়া, ইসলামাবাদ, মৌলভী পাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, হাতিয়ার ঘোনা, নতুন পল্লান পাড়া ও অলিয়াবাদসহ অনেকে গ্রামে এখনো রোহিঙ্গাদের বসবাস রয়েছে। 


অয়িাবাদের এক ভাড়া বাসার মালিক প্রবাসি মো. ইয়াছিন বলেন, ‘বিদেশে বসবাস করার কারনে এলাকা অনেক লোকজন অপরিচত। তাই কিছুদিন আগে দুটি পরিবার আমার ভাড়া বাসায় উঠেছিল। কিন্তু তারা যে রোহিঙ্গা ছিল সেটি আমার জানা ছিলনা। ফলে বিজিবি তাদের (রোহিঙ্গাদের) ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আমি আর কোন রোহিঙ্গা পরিবারকে বাসা ভাড়া দেয়নি।’  


আরও পড়ুন: ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৬৩১, আহত ১৯ হাজার


জানতে চাইলে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এটা সত্য যে আমার এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রামে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। অনেকে ভাড়া বাসায় থাকছে। এসব বিষয়ে আমি আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে একাধিকবার অবহিত করেছি। এরপরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা স্থানীয় বাসিন্দা অনিরাপদ আছি। কেননা ওপার থেকে অনেকে সশস্ত্র ধারী সন্ত্রাসী পালিয়ে আসার খবর পেয়েছি। এখনিই এটি ব্যবস্থা না নিয়ে সামনে আরো ভয়াবহ রুপ ধারন করতে পারে।’ 


অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই দেশের দালালের মাধ্যমে ২০ থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তে রাতে আধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এ অবৈধ রোহিঙ্গা পারাপারের বাণিজ্যে চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে সীমান্তের ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। 


পয়েন্টগুলো হচ্ছে-বান্দারবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রæ, টেকনাফ সীমান্তের জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং, চৌধুরী পাড়া, মৌলভী পাড়া, নাজির পাড়া, নয়াপাড়া, মেরিন ড্রাইভের মহেষখালীয়া পাড়া, তুলাতুলি ঘাট ও শাহপরীর জালিয়াপাড়া ও গোলারচর।



জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন,  টেকনাফ শহরসহ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন এলাকা ছড়িয়ে পরছে। বিষয়টি নিয়ে অতি দ্রæত যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের জনবল বাড়াতে কৃতপক্ষকে অবহিত করেছি।’



আরএক্স/