৮৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ১জন


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২:২৪ অপরাহ্ন, ১৯শে অক্টোবর ২০২৪


৮৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ১জন
ফাইল ছবি।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মোট আটজন শিক্ষকের পাঁচজনই রয়েছেন শিক্ষা ছুটিতে। ফলে বিভাগটির বিভিন্ন ব্যাচের বর্তমান ২৫৩ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র তিনজন শিক্ষক নিয়ে সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিভাগটি। এদিকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে আসতে চলেছে নতুন আরো একটি ব্যাচ।


শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হার নিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বলছে, বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের নূন্যতম মানদণ্ড হওয়া উচিত ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু কুবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রতি ৮৪ জন শিক্ষার্থীর জন্যে রয়েছেন মাত্র একজন শিক্ষক।


আরও পড়ুন: যৌন হয়রানির অভিযোগে বাকৃবি অধ্যাপককে শোকজ


সাম্প্রতিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে জানা যায়, সর্বশেষ এই বিভাগটিতে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিলো ২০২২ সালের জুলাইয়ের দিকে। প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন জাকিয়া জাহান মুক্তা। এই নিয়োগ পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আরো পাঁচটি বিভাগে নিয়োগ প্রাপ্ত হয় আরো ৫ জন প্রভাষক এবং একজন সহকারী অধ্যাপক। এরমধ্যে নৃবিজ্ঞান, আইসিটি, মার্কেটিং ও বাংলাতে একজন করে প্রভাষক এবং ইংরেজি বিভাগে একজন প্রভাষক এবং সহকারী অধ্যাপক। তখনও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে নিয়মিত শিক্ষক ছিলো মাত্র ৫ জন এবং ৩ জন ছিলো শিক্ষাছুটিতে। অথচ বিভাগটিতে শিক্ষক নিয়োগে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভাগটি থেকে শিক্ষা ছুটিতে গিয়েছে আরো ২ জন। ফলে নিয়মিত শিক্ষকের সংখ্যা দাড়িয়েছে মাত্র ৩ জনে।


পরবর্তীতে আরো একটি ধাপে সিন্ডিকেটে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২৩ এর নভেম্বরের দিকে। সেখানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে নতুন করে দুজন শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংকটের কারণে শুধু ফিনান্স ও ব্যাংকিং বিভাগে ১ জন প্রভাষক নিয়োগ সম্পন্ন হয়। এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্ব, কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাড়াও সাম্প্রতিককালে চলা নানান দুর্ভোগে আটকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক নিয়োগ।


দীর্ঘদিনেও বিভাগের শিক্ষক সংকট সমাধান না হওয়া নিয়ে বিভাগটির বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক কাজী এম. আনিছুল ইসলাম বলেন, 'একটি বিভাগে শিক্ষক নেই, আমি এই বিষয় নিয়ে প্রশাসনকে অসংখ্যবার অবগত করেছি। এখন প্রশাসন যদি এই সংকট না বুঝে তাহলে কি ধরে ধরে বুঝাবো আমি? প্রশাসন কি ছোট বাচ্চা? আমার দায়িত্ব আমি চিঠি পাঠিয়েছি অবগত করেছি, আমার এই সমস্যা, ঐ সমস্যা। এবার প্রশাসন এই সমস্যার গভীরতা বুঝার চেষ্টা করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে।'


এদিকে শিক্ষক সংকটে একজন শিক্ষকের উপর একাধিক কোর্সের দায়িত্বের জন্য তারা গবেষণার কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না, ফলে সেটি তাদের পদোন্নতিতেও নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। অনেকসময় বহিরাগত শিক্ষকরা সময় নিয়ে কোর্স সম্পন্ন করতে পারে না, ফলে একাধিক কোর্সের দায়িত্ব থাকা সত্বেও বাহিরের শিক্ষকের কোর্সের বাকিটুকু তাদেরকে দায়িত্ব নিয়ে শেষ করতে হচ্ছে। অনেকসময় মিডটার্ম, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনও নিতে হচ্ছে। ফলে অনুমিতভাবেই শিক্ষকদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও।


এনিয়ে কাজী আনিছুল বলেন, এই সমস্যাটার জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। আমাদের উপর অত্যধিক চাপের কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষাটা নিশ্চিতে ব্যাপক ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে।'


বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভাগে শিক্ষক সংকটের ফলে অধিকাংশ কোর্স বাহিরের শিক্ষকের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া বিভাগটির সেমিনার কক্ষে পর্যাপ্ত বইয়ের মজুদ নেই, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রুম নেই, ল্যাবরুম নেই, পানির ফিল্টারগুলো নষ্ট, ওয়াশরুমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই।


এই বিষয়ে বিভাগটির ৮ম ব্যাচের ২০২২-২৩ বর্ষের শিক্ষার্থী নিলয় সরকার বলেন, 'বিভাগে মাত্র তিনজন শিক্ষক, ফলে অধিকাংশ কোর্স পরিচালিত হচ্ছে বহিঃস্থ শিক্ষক দ্বারা। যার ফলে আমাদের পড়াশোনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।নেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ক্লাসরুম যদি শিক্ষার্থীবান্ধব না হয় তাহলে শিক্ষার মান কতটা নিশ্চিত হয় প্রশ্ন থেকেই যায়। প্র্যাকটিকাল কাজের জন্য নেই ল্যাব সুবিধা। এমনকি বিভাগে সুপেয় পানিরও পর্যাপ্ত সুবিধা নেই।'


আরও পড়ুন: ঢাকা কলেজে পাসের হার ৯৯.৮১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেলেন ৯৬৬ শিক্ষার্থী


বিভাগটির ষষ্ঠ ব্যাচের ২০২০-২১ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী ফাহমিদা কানন বলেন, 'শিক্ষক সংকটের ফলে আমরা ঠিকমতো ক্লাস পাচ্ছিনা, বর্তমান শিক্ষকদের একের অধিক কোর্সের ক্লাস করাতে হয়। ডিপার্টমেন্টের ল্যাব নেই যা আমাদের জন্য খুবই দুঃখের বিষয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিরাপদ পানির অভাব, ভালো ফিল্টারিং ব্যবস্থা না থাকায় ময়লাযুক্ত পানি পান করা লাগছে আমাদের বাধ্য হয়ে।


এনিয়ে বিভাগীয় প্রধান কাজী এম. আনিছুল ইসলাম বলেন, সেমিনার কক্ষে শিক্ষার্থীদের কোর্সের বইগুলো অন্তত আনার চেষ্টা করছি। তবে এই কেনাটাও পর্যাপ্ত না। এদিকে ডিন অফিসের যারা নিয়োগপ্রাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কর্মচারী, এখানে যারা কাজ করে তাদের পরিবর্তন করবো। দ্রুতই এর সমাধান হবে। তাছাড়া আমাদের ল্যাবরুম প্রস্তুত, শুধু সরঞ্জাম সেট-আপ বাকি রয়েছে। '


তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে শিক্ষক সংকটসহ আরো অন্যান্য যে সংকটগুলো আমাদের শিক্ষা জীবনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে, এগুলো নিয়ে প্রশাসনের কাছে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। লিখিতভাবেও কয়েকবার জানানো হয়েছে, কিন্তু প্রশাসন এখানে চরম উদাসীনতা এবং ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই সমস্যাগুলোর দ্রুত নিরসনের দাবি করছি।


বিভাগটির শিক্ষক সংকট নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, ‘বিভাগটিতে দুজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হয়ে আছে, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ বোর্ড গঠন করতে হবে, সিন্ডিকেট লাগবে। এগুলো ছুটির পরেই কাজ শুরু হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি দেখেছি, বিভাগটিতে এখন তিনজন শিক্ষক সারাদিন ক্লাস নিচ্ছে। খুবই নাজেহাল অবস্থা। ঠিকমতো রেজাল্টও তৈরি করতে পারছে না। আমি যতশীঘ্রই সম্ভব নিয়োগগুলো পূরন করবো।'


আরএক্স/