প্রকল্প পরিচালক মাজাহারুলের ৪ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন

মাফিয়া শামীমের এসকিউ গ্রুপের দখলে বিদ্যুৎ সেক্টর


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন, ২৪শে অক্টোবর ২০২৪


মাফিয়া শামীমের এসকিউ গ্রুপের দখলে বিদ্যুৎ সেক্টর
ছবি: জনবাণী

দেশের ট্রান্সফরমার এবং প্রিপেইড মিটারের টেন্ডারে এসকিউ গ্রুপের একচ্ছত্র আধিপত্য। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন শামীমের প্রতিষ্ঠান এসকিউ গ্রুপ বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের ফেভারিট ঠিকাদার। সাবেক প্রধাণমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির বদৌলতে আগের সরকারের আমলে তারা অসংখ্য কাজ পায়। বিভিন্ন নামে এসকিউ সরকারী বিভিন্ন সংস্থায় টেন্ডার বাণিজ্য করে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহক পর্যায়ে স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।


অনুসন্ধানে জানা গেছে,  এসকিউ গ্রুপ নেসকোতে শীর্ষক ৫ লাখ প্রিপেইড মিটার প্রকল্প এবং ১২ লাখ মিটার প্রকল্পে ৭ লাখ ৮০ হাজার মিটারের কাজ পায়। এই দরপত্রগুলোতে অংশ নেয়া বাকিরাও এসকিউ এর ছায়া প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৭ লাখ মিটারের কাজ পায়। ডিপিডিসি শীর্ষক এএমআই প্রকল্পে ৬.৫ লাখ প্রিপেইড মিটার এবং লোকাল টেন্ডারে ৮০ হাজার মিটারের কাজ পায়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে ৬ লাখের ও বেশি মিটারের কাজ হাতে রয়েছে এসকিউ গ্রপের যার মধ্যে এএমআই প্রকল্পে ২ লাখ মিটার, বিউবো-এডিবি শীর্ষক প্রকল্পে ২ লাখ ২০ হাজার মিটার এবং সরবরাহ মিটারের কাজে ২ লাখ ১০ হাজার মিটার।  


অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসকিউ গ্রুপ বিভিন্ন নামে ১৭-১৮ টি কোম্পানি খুলে রেখেছে। পরিস্থিতি বুঝে একেক সময় একেক কোম্পানি ব্যবহার করে। গ্লোবাল সার্ভিসেস, টিএস ট্রান্সফর্মার, ডিটেক, টেকনো, ন্যাশনটেক-এসকিউ এরই বিভিন্ন ছদ্মনামী কোম্পানী। এছাড়াও রয়েছে এসকিউ ক্যাবল এন্ড ওয়্যারস, এসকিউ ইলেকট্রিকাল ইত্যাদি। চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো বিভিন্ন কোম্পানিকে দিয়ে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে প্রতিযোগিতা দেখালেও আসলে এগুলো এসকিউ এরই প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনী হলফনামায় দেখা যায় আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন শামীম ১৪টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ৯টির ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ২টির ডিরেক্টর, ৪টির ম্যানেজিং পার্টনার এবং ৩টির পার্টনার। অকুলিন-এসকিউ এর নেতৃত্বে সাজানো টেন্ডার বাণিজ্য হয় বিআরইবি, ডিপিডিসি, নেসকো ইত্যাদি সংস্থায়।  


অনুসন্ধানী দেখা যায়, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের টেন্ডারের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ‘স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার অ্যান্ড মিটার কমিউনিকেশন সিস্টেম স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় লট-১-এ ৪ লাখ ৯০ হাজার স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার এবং মিটার কমিউনিকেশন সিস্টেম ক্রয়ের দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জেভিসিএ অকুলিন টেক বিডি লিমিটেডের মালিক হচ্ছেন শাদাব সাজিদ, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে ববির বন্ধু। একই জয়েন্ট ভেঞ্চারের অন্য প্রতিষ্ঠান এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেবলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন সাবেক গৃহায়ণমন্ত্রী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ এম ওবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী। আর প্রতিষ্ঠানটির মালিক হিসেবে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের নাম। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সূত্র আরো জানায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের ট্রান্সফর্মার দরপত্রেও দুর্নীতি ও জালিয়াতি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসা করে এসকিউ সিন্ডিকেট। রাজধানীর বনানীতে এসকিউ গ্রুপের প্রধান কার্যলয় রয়েছে, তবে অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। দৈনিক জনবানী’র অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, টেন্ডার বাণিজ্য ও জালিয়াতি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রিপেইড মিটারের এএমআই প্রকল্প পায় এসকিউ এবং তাদের ছায়া সংগঠন। ডিজাইন, সাপ্লাই, ইন্সটলেশন, টেস্টিং, কমিশনিং অফ এডভান্সড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই) শীর্ষক প্রকল্পে অকুলিন টেক বিডির সাথে মাত্র ২ লাখ প্রিপেইড মিটারের প্রকল্প তারা করে ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে। উচ্চ দামে এই প্রকল্প করা অর্থ মন্ত্রনালয় অসম্ভব জানিয়েছিলো। কিন্তু সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর চাপে বিশাল অংকের এই প্রকল্পের অনুমোদন হয়। আগের সরকারের পতন হলেও তাদের দোসরদের কাজ দিয়ে চক্রটিকে চাঙা রাখার ভার নিয়েছেন সরকারী সংস্থার আওয়ামীপন্থী অফিসাররা। সংশ্লিষ্টরা জানায় সরকার পরিবর্তন হলেও বড় অংকের ঘুষের লোভে ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রকল্প বাতিল না করে কিভাবে চালিয়ে নেওয়া যায় সেই পায়তারা করছেন কিছু কর্মকর্তা।    জানা যায়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এর অর্থায়নে ১০ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। চারটি লটে বিভক্ত হয়ে টেন্ডার হয়। চতুর্থ লটের ২ লাখ ২৮ হাজার ৮৫৬ টি প্রিপেইড মিটারের কাজ পায় এসকিউ। ময়মনসিংহ জোনের জন্য (জিডি-৪) নামের এই প্রকল্পটি আরেক দরপত্রদাতা সানসিং নিংবোর অভিযোগে এডিবি চতুর্থ লট নিয়ে নিবিড় পর্যালোচনা করে এবং চতুর্থ লটের অর্থায়ন বাতিল করে। এডিবির অর্থায়ন বাতিল হলেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নিজেদের অর্থায়নে হলেও প্রকল্পের এই অংশ এসকিউ গ্রুপকে দিতে তৎপর।


 বাংলদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের স্থাপন করা প্রিপেইড মিটারের সংখ্যা ১৫ লাখের অধিক। প্রক্রিয়ায় আছে ১৩ টি স্মার্ট মিটারের দরপত্র। এডিবি-বিউবো লট-৪ বা এউ-৪ এর টেন্ডার নোটিশ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর। দরপত্রের বৈধতা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আগের সরকারের পতন হলেও এসকিউ গ্রুপকে নিজেদের বাজেটে কাজ দিতে মরিয়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। 


বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের স্মার্ট মিটারিং ইন ডিসট্রিবিউশন জোনস এর প্রকল্প পরিচালক মাজাহারুল ইসলামকে ৪ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার চুক্তি করে এসকিউ গ্রুপ। মালিক পক্ষ বর্তমানে পলাতক হলেও সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে ঘুষ লেনদেন সামলাচ্ছেন নাফিসা ইসলাম। ঘুষের নেশায় মত্ত হয়ে বারবার প্রকল্পটি একনেক কমিটির সভায় উপস্থাপন করছে তদবিরের মাধ্যমে পদ পাওয়া প্রকল্প পরিচালক। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ বলেন, “ইলেকট্রনিক পণ্যের দাম সময়ের সাথে সাথে কমে। সেই সময়ের বাজার মূল্যের চেয়ে এখন আরো কম মূল্যে স্মার্ট প্রিপেইড মিটার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির টাকা মিটিয়ে গ্রাহকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য চ্যালেঞ্জ। সেখানে নিজস্ব অর্থায়নে আগের দামে অপ্রয়োজণীয় প্রকল্প হাস্যকর।” 


সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দীন (শামীম) ছিলেন জেলার সবচেয়ে বিত্তশালী এমপি। তিনি ছিলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। সাবেক এই এমপির এসকিউ গ্রুপ মিরসাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে প্রায় ২৭ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সাথে এই প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার-বাণিজ্য নিয়ে তদবির করতেন প্রথমে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। বিভিন্ন ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে স্বাধীণভাবে কাজ করতে না দিয়ে সিন্ডিকেট করেন তারা। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের এমপি মনোয়ন পাওয়া এ জেড এম শফিউদ্দিন শামীম মন্ত্রীর সাথে তদবিরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মূলত এসকিউ গ্রুপ ঠিকাদার হলেও তাদের ব্যানারের নিচে থাকা বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারক তাদের কাছে জিম্মি। 


এলাকার স্থানীয়রা জানায়, শফিউদ্দিন শামীম একজন ব্যবসায়ী গডফাদার। বর্তমানে তিনি পলাতক। তার ব্যবসার পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, বোর্ড এবং পরিচালক হিসেবে আছেন বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। যে দলই সরকার গঠন করুক না কেনো, সে দলের নেতাকে মুখপাত্র করে সামনে নিয়ে এসে সরকারের সাথে সমঝোতা করে ফিরে আসবে বর্তমানে পলাতক চেয়ারম্যান ও কোম্পানির অন্যান্য দায়িত্বে থাকা তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।


এ ব্যাপারে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,  দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। প্রভাবশালীরা জড়িত থাকে তাদেরকে ছাড় দেওয়া ঠিক না। জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে দুর্নীতি বন্ধ হবে। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিন, দেখবেন দুর্নীতি কমে যাবে।


এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান  বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখনো কোনো অভিযোগ পাই। তা ছাড়া কারো একক অনেক প্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ নাই। অভিযোগের সতত্যা পেলেই ব্যবস্থা।  


জেবি/এসবি