টাকার কুমির অতিরিক্ত ডিআইজি মাসুদ!
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১২:২৪ অপরাহ্ন, ৫ই নভেম্বর ২০২৪
# স্ত্রী-সন্তানের ব্যাংক একাউন্টে বিপুল পরিমাণ লেনদেন
# শুধু ঢাকায় নয়, মালয়েশিয়াতেও স্ত্রীর নামে অট্টালিকা
# প্রমাণ দিতে পারলে সব সম্পতি লিখে দিবো
- এবিএম মাসুদ হোসেন, অতিরিক্ত ডিআইজি, রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি
# বিচারের মুখোমুখি না করলে দুর্নীতি বাড়বে
-ফারুখ ফয়সল, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
পুলিশ-প্রশাসনে এবিএম মাসুদ হোসেন নামেই পরিচিত রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমির অতিরিক্ত ডিআইজি (মূল্যায়ন)। কিন্তু নিজ এলাকা বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের মানুষের কাছে তিনি মিন্টু নামে পরিচিত। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকান্ডের পর এসপি মাসুদের সরল চেহারার আড়ালে অন্ধকার আরেকটি জগত রয়েছে তা বেরিয়ে আসায় তার নিজ এলাকার মানুষই এখন বিস্মিত। এই পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ এখন টাকার কুমির। স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পদ গড়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন কক্সবাজারের সাবেক এসপি।
দুদক সূত্রে তার কিছু সম্পদের তথ্য প্রমাণ উঠে এসেছে। পুলিশে যোগদানের পূর্বে পৈত্রিক ভিটা ছাড়া কিছুই ছিলনা মাসুদের। অথচ, এখন ঢাকা এবং তার আশে পাশেই কেটি কোটি টাকার সম্পদ এই মাসুদের। দুদক সূত্রের তথ্যে, মাসুদ শত কোটি টাকার মালিক। অথচ, সবমিলিয়ে চাকুরী জীবনে দেড় কোটি টাকার মত বেতন পেয়েছেন। জনগনের সেবার আড়ালে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। মাসুদকে মামলার আসামি করতে আদালতে আবেদন করেছিলেন নিহতের বোন। পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদের বিরুদ্ধে মাদক কারবারিদের একপক্ষকে ক্রসফায়ার, আরেকপক্ষের পৃষ্টপোষকতা দেওয়া ও মাদক কারবারিদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদের নিজের ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেলদেনের অভিযোগ রয়েছে। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম এ অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন।
শিক্ষিত ঘরোনার সন্তান এবিএম মাসুদ ওরফে মিন্টু এক সময় ঢাকার একটি প্লট কিনতে আর্থিক দৈন্যতায় বন্ধুদের সহায়তা চেয়েছিল। সেই এবিএম মাসুদ কক্সবাজার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হয়েছেন কোটিপতি। শোনা যায় শুধু ঢাকায় নয়, মালয়েশিয়াতেও স্ত্রীর নামে অট্টালিকা রয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এসব তথ্য উঠে এসেছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রকৃতঅর্থেই প্রদীপের ন্যায় জ্বালিয়ে নিজে অন্ধকারে থেকে এই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং নীতি নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
দুদকের তথ্যমতে, এবিএম মাসুদ হোসেন ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজারের এসপি হিসেবে যোগদান করেন। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে বদলী করা হয়। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি অতিরিক্ত ডিআইজি (মূল্যায়ন) হিসেবে কর্মরত। ২০২৩ সালের জুন মাসে পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ জমা হয় দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলামকে নিয়োগ দেন। তিনি অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত বছরের ৩০ জুলাই দেশের ব্যাংক, বীমা, রাজউক, সিটি করপোরেশন, রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠান। দুদকের চিঠিতে বলা হয়, পুলিশের কক্সবাজারের সাবেক এসপি মাসুদসহ (বর্তমানে রাজশাহী) কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ লেনদেন হওয়ায় লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস আড়াল করাসহ মানিলন্ডারিং অপরাধ ও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে।
অনুসন্ধানের স্বার্থে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কোনো রেকর্ডপত্র থাকলে তা দুদকে পাঠানোর জন্য বলা হলো। চিঠিতে পুলিশ সুপার মাসুদ, তার স্ত্রী জেনেফার রেবেকা ও দুই সন্তান জাওয়াদ রাফিদ এবং আবরার জারিফ এর তথ্য চাওয়া হয়েছে। ওই চিঠির পর কয়েকটি দপ্তর থেকে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ দুদকে পাঠানো হয়েছে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এসপি মাসুদের বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান চলমান আছে। অভিযোগ তথ্য-প্রমাণ বিভিন্ন দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেসব রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণ ওলানিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের আব্দুল কাদের হাওলাদার ও অজুফা খাতুনের ছেলে এবিএম মাসুদ হোসেন। তিনি ২৪তম বিসিএসে এএসপি হিসেবে যোগদান করেন। তিনি স্ত্রী জেনিফার নামে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নামে-বেনামে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, কক্সবাজারে প্রায় ৩০০টি হোটেল রয়েছে। এইসব হোটেল থেকে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদি কোনো হোটেল মালিক টাকা দিতে রাজি না হন তাহলে ওই হোটেলে অবৈধ কারবার পরিচালনার নামে অভিযান চালানোর হুমকি দেওয়া হতো। অভিযোগে বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ কক্সবাজারে ১ বছর ৮ মাসের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্বকালীন সময়ে মাদক কারবারিসহ সর্বমোট ১৪৮ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন।
এসব ক্রসফায়ারের বেশির ভাগই পরিকিল্পতভাবে দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও এসপির সম্পৃক্ততা ছিল। আবার পুলিশের ছত্রছায়ায় অনেক মাদক কারবারি নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। তারা মূলত পুলিশকে টাকা দিয়ে মাদক কারবার চালাতেন। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার একটি অংশ এসপি মাসুদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হতো। ব্যাংক লেনদেন ছাড়াও মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের একটি অংশ দিয়ে দেশে-বিদেশে স্থাবর-অবস্থাবর সম্পদ ক্রয় করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যার ঘটনায় এসপি মাসুদকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেছিলেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। তবে সেই আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। সেনা কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের পর ক্রসফায়ার বাণিজ্য ও মাদক ব্যবসায় মদদ দেয়ার মাধ্যমে টাকা কামানোর ঘটনাটি আলোচনায় আসে।
দুদকের অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের ভাষ্যে উঠে আসে এসপি মাসুদের নানা অনিয়মের তথ্য। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ইয়াবার সরবরাহের নামে হয়রানি, মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে অর্থ আদায়, টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়া, বড় মাদক ব্যবসায়ীদের না ধরে চুনোপুঁটিদের ধরা এবং ক্রসফায়ার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। তিনি মূলত কক্সবাজারের ইয়াবার নিয়ন্ত্রক। জেলাবাসী তাকে রংবাজ মাসুদ হিসাবেও চিনতেন। মাদক ব্যবসা পরিচালনা, মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা, তার নিয়ন্ত্রিত ওসি ও পুলিশ কর্মকর্তারা মাদক মামলার ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্রসফায়ার ও হয়রানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসপি মাসুদের নিয়ন্ত্রণে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ৩২ সদস্যের শক্তিশালী একটি বাহিনী। ওই বাহিনীতে ৬ জন এসআই, ৫ জন এএসআই ও ৩ জন কনস্টেবল ছিল। এই বাহিনী বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে যাতায়াত এবং মাদক পাচার করতো। কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ব্যবসা হয়েছে তাদের হাত ধরে। তিনি ইয়াবা ডন হিসেবে চিহ্নিত ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে কোটি টাকার বিনিময়ে আত্মসমর্পণের নামে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যদিকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে মাদক বহনকারী চুনোপুঁটিদের। এতে ইয়াবার সর্গরাজ্য কক্সবাজারে যেমন ছিল তেমনই আছে।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে ঘুরে প্রায়াত স্কুল শিক্ষক আব্দুল কাদের হাওলাদারের পুত্র এবিএম মাসুদ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তাতে এলাকায় তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। বছরে দুই একবার ঈদ উৎসবে এলাকায় আসলে তার চলন-বলন এতটায় স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি কক্সবাজারের দাপুটে এসপি এবং অল্প বয়সে স্বল্প সময়ে অঘাত অর্থের মালিক হয়েছেন। নিশ্চিত হওয়া গেছে, মাসুদের গোটা পরিবারই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তার বাবা গোবিন্দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং দলের জন্য ছিলেন নিবেদিত।
মেঘনা নদী ভাঙনের পর গোবিন্দপুর ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে এপারে দক্ষিণ উলানিয়ার রাজাপুরে নতুন বসতি গড়ে তোলা আব্দুল কাদের হাওলাদার ও অজুফা খাতুন দম্পতির পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। মেঝো পুত্র টেক্সাটাইল ইঞ্জিনিয়ার, থাকেন ঢাকায়। অপর দুই ভাইয়ের একজন গোবিন্দপুর ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আরেক ভাই একই উপজেলার পাতারহাটে শিক্ষকতা করেন। তার এক কন্যা সন্তানও শিক্ষিকা হিসেবে গ্রামে খুব সুনামের সহিত রয়েছেন। কিন্তু তৃতীয় পুত্র এবিএম মাসুদ ওরফে মিন্টুর কিভাবে উত্থান সে সম্পর্কে এলাকাবাসীর সম্মুখ ধারনা নেই। মেহেন্দিগঞ্জের উত্তর শাহাবাজ জজ ইনস্টিটিউট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পরই তিনি ঢাকায় ওঠেন। বিসিএস ক্যাডার ভাইয়ের বাসায় থেকে রাজধানীর লক্ষীবাজারস্থ সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ২৪তম বিসিএসে শিক্ষানবিশ এএসপি হিসেবে তিনি পুলিশ প্রশাসনে যোগদান করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (টিআর) পদে দায়িত্ব পালনকালীন ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাসুদ পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পান। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবিএম মাসুদ তার শ্বশুর বরিশাল আওয়ামী লীগের পরিচিত মুখ সদ্য প্রায়াত আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন কাবুলের মাধ্যমে ঢাকায় কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের অনেক নেতার সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলায় এমনকি সরকারের উচ্চপর্যায়েও মাসুদের বিষয়ে নীরব ছিল। বরিশাল আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অর্থাৎ পিপি হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। প্রায়াত আওয়ামী লীগ নেতা কাবুলের দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে জেষ্ঠ্য জেনিফার মুনকে ইসলামী ব্যাংকে চাকুরি পাওয়ার পরই বিবাহ করেন এবিএম মাসুদ ওরফে মিন্টু। শ্বশুরের মৃত্যুর পর এবিএম মাসুদের শক্তি কিছুটা খর্ব হয়। কিন্তু শ্বশুর কাবুলের মৃত্যু পূর্বে একদিকে শ্বশুরালয়ের শক্তি অন্যদিকে ভাই একজন সচিবালয়ে থাকায় মিন্টুকে পুলিশ প্রশাসনে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এবিএম মাসুদ হোসেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা কক্সবাজার, যা পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো জায়গা, সেখানকার পুলিশ সুপার হিসেবে তিনি যোগদান করেন। এর পূর্বে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাধিক গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় শুধু টেকনাফ নয় গোটা কক্সবাজারের ৮টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই এসপিকে ম্যানেজ করে অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আর্থিক শক্তভিত তৈরির এক স্বর্ণযুগ তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে ইয়াবা ও অস্ত্র পাচার বন্ধের নামে শুরু হয় পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে অনৈকিতার এক ধরনের প্রতিযোগিতা।
এ ব্যাপারে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি অতিরিক্ত ডিআইজি (মূল্যায়ন) এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, আমি দুর্নীতি করি না। যদি কেউ প্রমান করতে পারে, তাহলে আমার সব সম্পতি তাকে লিখে দিবো। তিনি আরো বলেন, আমি যা আয় করেছি বৈধ ভাবে আয় করেছি। কোনো অবৈধ সম্পদ নাই। দুদক কি করবে তা আমি বলতে পারি না। দুদক যদি আমাকে জানতে চায় আমি আমার সম্পদের হিসাব দিবো।
দেখা যায়, এসপি এবিএম মাসুদের আমলেই কক্সবাজারে প্রায় ৩ শতাধিক ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে প্রদীপ একাই ২৮৭টি বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ডের নায়ক হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদকও লুফে নেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ ক্রসফায়ারের নেশায় এতটাই উন্মাত ছিলেন যে, কাউকে গুলি করে হত্যা করতে না পারলে কুকুর মেরে নেশার ঘোর কাটান। আবার কাউকে ক্রসফায়ারে অপর থানার ওসিকে ম্যানেজ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মর্জিনাকেও সঙ্গী করে বিভিন্ন ক্রসফায়ার নাটক সাজানোর অভিযোগ রয়েছে।
চোখ কপালে ওঠার মতো তথ্য পাওয়া গেছে যে, প্রদীপসহ অপরাপর থানা কর্মকর্তারা একেকটি ক্রসফায়ার দিয়ে নাটকের ডালা সাজাতেন তাতে এসপি মাসুদ যেমন সায় দিতেন, তেমনি কখনও নিজেও পরিকল্পনা এঁকে দিতেন। ক্রসফায়ার নিহতদের অধিকাংশই ছিল কোন না কোন মহলের প্রতিপক্ষ। আবার কেউ নীরহ গোছের ব্যক্তি। ক্রসফায়ার দেয়ার আগে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেই নাটকীয় কাহিনী তৈরি করা হত। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসপি মাসুদের অতি উৎসাহী এবং এর পেছনে আর্থিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিহিত থাকার ঘটনা জেলার অন্যান্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অবগত হওয়ায় এই পুলিশ কর্মকর্তার দুর্বলতা জেনে তারাও মাদকসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। অনেক নীরহ ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলেনিয়ে হত্যা, আবার কখনও মোটা অংকের লেনদেনে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়ায় এসপি মাসুদের গ্রীণ সিগনাল থাকতো। এভাবে গোটা কক্সবাজার জেলাকে এমন ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিল যে পুলিশ হাত বাড়ালেই চলে আসতো টাকার বস্তা। নচেৎ কোন না কোন সড়কের পাশে পড়ে থাকতো কথিত ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তির লাশ। এমন ঘটনাও ঘটেছে আর্থিক লেনদেনে বনিবনা না হওয়ায় ব্যক্তি বিশেষকে বাড়ি থেকে ধরে প্রাক্কালে তার স্বজনদের জানিয়ে আসতো আগে-ভাগেই কবর খুঁড়ে রাখার জন্য।
কক্সবাজার জেলায় এ ধারা চালু করতে কৌশলি এসপি এবিএম মাসুদ ওরফে মিন্টু সরকারের মাদক অভিযানের সুযোগ নিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে নিজের দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা প্রমাণে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারকে মাদকমুক্ত এলাকা হিসেবে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর এই সাফল্য দেখাতেই ওসি প্রদীপকে মোখ্যম কর্মকর্তা বা আস্থাভাজন হিসেবে ‘যা খুশি তাই করো’ এরূপ ক্ষমতা দিয়েছিলেন। সরকারি সংস্থা দুদকের তদন্ত সূত্র বলছে, মহেশখালীর ৬৮ জন জলদস্যুর আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিলের ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় প্রদীপকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ থাকলেও ১৫ দিনের মাথায় প্রদীপকে টেকনাফের ওসির দায়িত্ব দেন এসপি মাসুদ।
কথিত আছে-উড়ন্ত ইয়াবা ডন হিসেবে চিহ্নিত ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে কোটি টাকার বিনিময়ে আত্মসমর্পণের নামে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে মাদক বহনকারী চুনোপুঁটিদের। এতে ইয়াবার রাজ্য কক্সবাজারে যেমন ছিল তেমনই আছে। পাশাপাশি প্রদীপের ন্যায় একজন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও এসপি মাসুদের সম্পদের পাহাড়।
মেহেন্দিগঞ্জের মানুষের কাছে নিজের সাচ্ছা সৎ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে জাহির করতে দক্ষিন উলানিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে চারচালা টিনের চালের ঘর তৈরি করে সেখানেই বেড়াতে এসে সাদাসিদেভাবে বাজার-ঘাটে বসতেন এবং বলতেন তিনি অন্যায়ের কাছে আপোষ করতে পারেন না। এলাকায় তাদের তেমন ফসলী জমিজমা নেই। চাকুরির ওপর নির্ভরশীল গোটা পরিবারটির পরিচয় শিক্ষক পরিবার হিসেবেই।
গোয়েন্দা নজর এড়াতেই তিনি এই কৌশল নিয়েছিলেন এমনটি এখন ভাবা হচ্ছে। কিন্তু মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ার বাসিন্দারা বিশ্বাস করতে পারছেন না সেই এবিএম মাসুদ ওরফে মিন্টুর চেহারার আড়ালে আরেকটি ভয়ঙ্কর রূপ লুকিয়েছিল। এসপি এবিএম মাসুদের এক সহপাঠি অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, আসলে এখন যা শোনা যাচ্ছে, তা এখনও তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না তার অতীত জীবন ও পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায়। এমনকি গ্রামে থাকা ভাই-বোনরাও এসপি মাসুদ ওরফে মিন্টুর অপকর্মের লজ্জায় নুয়ে পড়েছেন, কথা বলতে চান না মিডিয়ার সাথে। মানুষজন এড়িয়ে চলছেন। অথচ মাসুদের ক্ষমতার রাজ্য সাবেক মেজর সিনহাকে হত্যার পেছনে তার হাত ছিল এবং তার আর্থিক উত্থ্যান কিভাবে ঘটেছে তা এখন প্রকারন্তরে বেরিয়ে আসায় সবাই হতবাক।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নকর্মী ফারুখ ফয়সল বলেন, এসপি মাসুদের দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে তিনি ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করে কালো টাকার পাহাড় গড়েছেন। তাদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। না হলে দুর্নীতি দিন দিন বাড়বে।