স্বৈরাচারের দোসর মাসুদের ৩ শত কোটি টাকা লুটের মহাযজ্ঞ
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১২:৫৭ অপরাহ্ন, ৩০শে জুন ২০২৫

#ফলাফল শুন্য: তবুও কোটি কোটি টাকা ব্যয়
টেন্ডার কারচুপি, আমলাদের যোগসাজশ আর পুরস্কার
#ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের নামে রাষ্ট্রের অর্থ বেহাত
# স্বার্থের সংঘাতে বিদেশ সফর ও ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলেও মিলল টেন্ডার
# তদন্তের মাঝে কাজ দেওয়া ঘোরতর অনিয়ম
-ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
স্বৈরাচার পতনের ৯ মাস পরও পরিবর্তনের আভাস মেলে না, যদি মাসুদ আলমের গল্প শোনা যায়। সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের আস্থাভাজন, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, যুব কাউন্সিলের সভাপতি মাসুদ আলম এই একটি নামের পেছনে রয়েছে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ‘ডিজিটাল লুটপাট’-এর গল্প।
২০২০ সালে গঠিত একটি কোম্পানি ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড যার নাম আগে কখনো কেউ শুনেনি। অথচ রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ২৯৭ কোটি টাকার বিশাল ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্পের দায়িত্ব বর্তায় এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এখন অর্থ পাচার, ডিজিটাল প্রতারণা, ভুয়া সার্টিফিকেট ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দুদকের তদন্ত শুরু হয়েছে।
সরকারি টেন্ডারের নিয়ম অনুযায়ী, ১০ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন প্রকল্পে কাজ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ ২০২০ সালে গঠিত ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড মাত্র তিন বছরের মাথায় ৩০০ কোটি টাকার টেন্ডার পেয়ে যায়, তাও টেন্ডার শর্তে স্পষ্ট অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক ছিল।
দুদকের একাধিক অনুসন্ধান সূত্র বলছে, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ খান টেন্ডার শর্ত এমনভাবে তৈরি করেন যেন মাসুদের প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ এগোতে না পারে। এই ধরনের সাজানো টেন্ডার সরকারবিরোধী ট্রানজিশনাল সময়েও নতুন প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট বার্তা দেয় পুরনো গডফাদাররা এখনও সক্রিয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাসুদ আলম ও প্রকল্প পরিচালক একাধিক বিদেশ সফরে গিয়েছেন একসঙ্গে। সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকের এমন ঘনিষ্ঠতা প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রকল্প অনুমোদনের কিছুদিন আগেই তাদের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া সফরের নথিও সংগ্রহে এসেছে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে শতকোটি টাকার কাজ দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার করা হয়েছে। চলমান তদন্তের মাঝেও তাদের কাজ দেওয়া ঘোরতর অনিয়ম। এই কার্যাদেশ বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা জরুরি।”
এই প্রকল্প ঘিরে শুধু মাসুদ নন, আড়াল থেকে জড়িয়ে আছেন ক্ষমতাধর আমলারা। সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেসবাহ উদ্দিন ২০২২ সালে সচিব থাকাকালে একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্পের নকশা তৈরি করেন, যার ভিত্তিতে মাসুদের প্রতিষ্ঠান প্রকল্প পায়। পরে মেসবাহ উদ্দিন নিজেই ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান ও শেয়ারহোল্ডার হন।
এছাড়া মাসুদের আরেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেড-এ শেয়ারহোল্ডার তার আরেক ঘনিষ্ঠজন, সাবেক সচিব আখতার হোসেনের স্ত্রী মাহবুবা আক্তার। আরজেএসসির নথি অনুযায়ী, এই কোম্পানিতেও যুক্ত ছিলেন আরেক আমলা মো. নাসির উদ্দিন। মাসুদ আলম ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাতেই আস্থা নামে একটি ফেসবুক পেজ পরিচালনা করতেন সামরিক সচিবের তত্ত্বাবধানে। পেজটি নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে তার এই সেবার পুরস্কারস্বরূপ দেওয়া হয় জাতীয় যুব পুরস্কার, শেখ হাসিনা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড এবং সর্বশেষ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩।
তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ও সুবিদিত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের (রবিউল-রানা) কমিটির সহসম্পাদক, গাইবান্ধার গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং নাহিম রাজ্জাক এমপির ঘনিষ্ঠ কর্মী। এত পরিচয়ের ভিড়ে প্রশ্ন হারিয়ে গেছে যোগ্যতা কোথায়?
প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, পূর্বের সরকার আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, কিন্তু এর সুফল পাওয়া যায়নি। মাসুদ আলমের প্রকল্পও সেই ব্যর্থতারই নতুন সংস্করণ।
অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে যখন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব চরমে, তখন ফ্রিল্যান্সার তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে প্রকৃত প্রশিক্ষণহীন একটি প্রজন্ম দাঁড় করানো হচ্ছে।
টিআইবি বলছে, সময় এসেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নয়, বাস্তব প্রয়োজন ও দক্ষতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের।
এ বিষয়ে মাসুদ আলম এর মুঠো ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।